মোগল সাম্রাজ্যের বাদশা আকবরের পুত্র সেলিম, যাঁর জীবনের রঙ বদলে দিয়ে গিয়েছিলেন আনারকলি। নর্তকীর মায়াবি রূপে সেলিম হয়েছিলেন নিঃস্ব। সাম্রাজ্য, সিংহাসন নয়, চেয়েছিলেন এক কঠিন পরিস্থিতির সন্মুখীন হয়ে আনারকলিকে যোগ্য সন্মান দিতে। তবে নিয়তির কলমে তখন অন্য রাজকাহিনি। মিলন নয়, বিচ্ছেদেই হোক এই প্রেমের ইতিকথা, বিচ্ছেদ হোক এতটাই নির্মম, কঠিন, যা ইতিহাস মনে রাখবে।... এই অমর কাহিনি যখন প্রতিটা ফ্রেমে জীবন্ত হয়ে উঠল, সৃষ্টি হল মুঘল-ই-আজম, ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস এক নয়া অধ্যায় গড়ল, সৃষ্টি হল কালজয়ী ছবি, পর্দায় প্রেম দশকের পর দশক মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিল...
নির্বাক যুগে আনারকলি
নির্বাক ছবির যুগ থেকে পথ চলা শুরু। ভারতীয় ছবি তখনও পায়নি ভাষা। ১৯২২ সাল, ছবির জগত তখন সবে পরিণত হচ্ছে, এমনই সময় সেলিম-আনারকলির প্রেমকাহিনি প্রথম জায়গা করে নিয়েছিল নাট্য-মঞ্চে। নাট্যকার ইমতিয়াজ আলি। আরদাশির ইরানি ‘আনারকলি’ নামে প্রথম ছবি তৈরি করেন ১৯২৮ সালে। ছবি তখনও নির্বাক। এরপর ভারতীয় চলচ্চিত্র জগত যখন ভাষা পেল, এই ছবি মুক্তি পেয়েছিল আরও একবার। এরই কয়েকবছর পর থেকেই শুরু মুঘল-ই-আজম ছবি নিয়ে জল্পনা।
কঠিন সময়ের সিদ্ধান্ত
চল্লিশের দশকের শুরু, বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে চলচ্চিত্র জগতও তখন দেখছে একাধিক নয়া অধ্যায়, ছবির ঘরানা ভেঙে নয়া বুনটে চলছে সংযোজন, উপস্থাপনের আমুল পরিবর্তণের পালা। একদিকে যখন আর্থিক অভাব বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ইতালিয় নয়াবাস্তববাদের সূচনা করছে, সেই ১৯৪৪ সালেই ভারতের বুকে রচনা শুরু হয়েছিল, তৎকালিন বিগ বাজেটের ছবির, শুরু পরিকল্পণা। পরিচালক কে আসিফের নজরে তখন সেলিম-আনারকলি।
চিত্রনাট্যে বিভ্রাট
শুরু হয়ে যায় স্বপ্নপূরণের কাজ। চিত্রনাট্যের ভার বর্তায় আমানুল্লাহ খান, ওয়াজাহাত মির্জা, কামাল আমরোহি এবং এহসান রিজভির ওপর। তড়িঘড়ি নির্বাচণ করা হয় তারকাদেরও। চন্দ্রমোহন পাবেন আকবর, ডি.কে.সাপ্রু পাবেন সেলিম ও নার্গিসকে দেওয়া হয় আনারকলির পাঠ। বিখ্যাত বম্বে টকিজ স্টুডিওতে ছবির কাজ শুরু হয় ১৯৪৬ সালে। কিন্তু তা পূরণ হয় না, ১৯৪৭-শের উত্তাল পরিস্থিতিতে বদলে যায় স্বাভাবিক ছন্দ, দেশভাগে প্রযোজক সিরাজ আলি চলে যান পাকিস্তানে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন অভিনেতা চন্দ্রমোহন।
পঞ্চাশের দশকে মুঘল-ই-আজম
বিপুল অঙ্কের টাকার প্রয়োজন, এমনই পরিস্থিতিতে পার্সি ব্যবসায়ী শাপুরজি প্রযোজনার ভার গ্রহণ করেন, গল্পে আকৃষ্ট হয়েই এই সিদ্ধান্ত। আবারও শুরু হয় ছবির কাজ, স্থির হয় অভিনেতা অভিনেত্রী। পৃথ্বীরাজ কাপুর, দিলীপ কুমার ও মধুবালা করবেন ছবি, ১৯৫৩ সালে শুরু হয়ে যায় ছবির কাজ। সব যেন আবারও স্বাভাবিকের পথে। ছবি নিয়ে আবার চোখে স্বপ্ন বুনছিলেন পরিচালক।
ছবির পথে একাধিক বাধা
মধুবালা-দিলীপ কুমারের সম্পর্কে বিবাদ, পরিচালকের সঙ্গে দিলীপ কুমারের বিবাদ, কিছুতেই যেন ছন্দে ফিরছে না ছবি। শ্যুটিং সেটে দিলীপ কুমার-মধুবালা কথাও বলতেন না একে অন্যের সঙ্গে, অথচ ছবির পর্দায় যাঁদের উপস্থাপনা আজও মানুষকে এক অমর প্রেমের গল্পে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পলকে। যেভাবে প্রতিটা ফ্রেমে সেলিম-আনারকলির সম্পর্কের ভাঙন ধরা দিয়েছিল, বাস্তবেও ঠিক সেই পরিণতিই ঘটেছিল দিলীপ কুমার ও মধুবালার সম্পর্কে।
টাকা উড়িয়ে সঙ্গীত পরিচালনা
ছবির সঙ্গীত পরিচালনাতে ছিলেন নৌশাদ। আসিফ নৌশাদকে জানিয়েছিলেন তিনি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গান চান, কিন্তু তার জন্য দিয়েছিলেন ব্যাগ বোঝাই টাকা, যা ভালো চোখে নিতে পারেননি নৌশাদ, তিনি টাকা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বেঁকে বসেন, পরবর্তীতে আসিফ ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়, টাকার বিনিয়ম শ্রেষ্ঠ্যত্ব দাবি করা যায় না, নৌশাদ সাফ জানিয়েছিলেন পরিচালকে। এরপর যা সৃষ্টি হয় তা আজও বলিউডে এক কথায় জিন্দাবাদ।
প্রায় দেউলিয়া প্রযোজক
তখনকার সময় এই ছবি তৈরি করতে গেলেছিল বিপুল অঙ্কের অর্থ। ছবির সেট থেকে শুরু করে কস্টিউম, কাস্ট সব মিলিয়ে খরচ পড়েছিল প্রায় ২ কোটি টাকা। যার যোগান দিতে প্রায় দেউলিয়া হতে বসেছিলেন ছবির পরিচালক। যদিও এই ছবি চলেছিল ২৫ সপ্তাহ ধরে, আর বক্স অফিসে উপচে পড়েছিলেন আয়ের পরিমাণ। এই ছবির সেট আজও সকলকে অবাক করে।
প্যায়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া
এই সেটের সঙ্গে জড়িয়ে একাধিক ঘটনা। মধুবালা তখন অসুস্থ, বার বার শ্যুটিং চলাকালিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, তবুও থেমে যাওয়া নয়। শ্যুট শেষ করে তবেই তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এই গানের সেটের কথা সকলেরই হয়তো মনে আছে, যা তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় দুবছর। খরচ হয়েছিল ১৫ লক্ষ টাকা। এই গানের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে আরও গল্প। লতা মঙ্গশকর গানটি গাইবার সময় উপলব্ধ করেন তা ইকো করা সম্ভব হচ্ছে না। পরবর্তীতে গানটি গাওয়ানো হয়েছিল বাথরুমে।
আসল যুদ্ধের ময়দান
তখন ছিল না গ্রাফিক্স, ভিএফএক্সের রমরমা। তাই যুদ্ধের ময়দান হতে হবে আসল, নয়তো ছবিতে খামতি থেকে যাবে, কীভাবে সম্ভব! যুদ্ধের দৃশ্যে ২০০০ উট, ৪০০০ ঘোড়া, ৮০০০ সেনা তৎকালীন ভারতীয় সেনাদলের থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। পরিচালক আসিফ চেয়েছিলেন এই ছবিকে এক ভিন্ন লুক দিতে যা এককথায় ইতিহাস গড়বে, তেমনটাই হয়েছিল, মুঘল-ই-আজম সেরার সেরা উপাধি পেয়ে আজও স্বর্ণাক্ষরে ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নিজের নাম লিখে রেখেছে।
১০০ জন কোরাস দিয়ে গাওয়ানো এ মহবত জিন্দাবাদ গান যেভাবে গল্পের ইতি টেনেছিল, ছবির জয়জয়কার ঠিক তেমনই বছরের পর বছর ধরে দর্শকমহলে ঝড় তুলে এসেছে। হাজারও বাধা বিপত্তি, ওঠাপড়ার গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবির পেছনে থাকা ঐতিহাসিক নির্মাণ কাহিনি, যা নির্মম ঐতিহাসিক প্রেমকাহিনিকে প্রাণ দিয়েছে প্রতিটি ফ্রেমে।