যেমন ছিল তাঁর কৌতুকবোধ, তেমনই গালিব ছিলেন একজন অহংকারী মানুষ

  •  ইতিহাসের চরম এক সন্ধিক্ষণকে প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের জীবন দিয়ে
  • উর্দু কাব্য সম্রাট মির্জা গালিবের আজ জন্মদিন
  • বিস্ময়ের ব্যাপার হল; চূড়ান্ত হতাশা, দারিদ্র
  • কের পর আঘাতেও থেমে যায়নি মির্জা গালিবের লেখনী

Asianet News Bangla | Published : Dec 28, 2020 7:32 AM IST / Updated: Dec 28 2020, 01:17 PM IST

তপন মল্লিক, কলকাতা-  যে মানুষটি এ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের চরম এক সন্ধিক্ষণকে প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের জীবন দিয়ে- ১৮৫৭ সালের র দিল্লীর ভয়ংকর হত্যাকান্ড, লুটতরাজ, দিল্লির সম্রাটের  নির্বাসন, এমনকি  নিজের ভাগ্য বিপর্যয় সেই উর্দু কাব্য সম্রাট মির্জা গালিবের আজ জন্মদিন। দিল্লির সেই অগ্নিময় দিনগুলির বর্ণনা মেলে তাঁর দিনলিপি ‘দাস্তাম্বু’-তে। নিজের পেওনশনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারংবার আবেদন নিবেদিন জানিয়েছেন।করেছেন। সাহায্যের আশায় কলকাতাতেও এসেছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। 

কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল; চূড়ান্ত হতাশা, দারিদ্র, একের পর আঘাতেও থেমে যায়নি মির্জা গালিবের লেখনী। চরম দুঃখকেও সুক্ষ্ম রসিকতায় হটিয়ে দিয়েছেন। উড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্রুপের বাঁকা হাসিতে। মির্জা গালিবের কাব্যের রসবোধ আর কৌতুক আজও উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তার কাব্যের পংতিতে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁরই জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনা। 
গালিবের রচনা যেমন মানুষের সুক্ষাতিসুক্ষ অনুভবে পূর্ণ তেমনই তাঁর কৌতুকবোধ। গালিবের একবন্ধু একদিন তাঁকে জিঙ্গাসা করলেন, দিল্লীতে ‘রথ’কে কোথাও স্ত্রী লিঙ্গ আবার কোথাও পুং লিঙ্গ বলে, মির্জা আপনি তো কবি, বলুন তো ‘রথ’ স্ত্রী লিঙ্গ না পুরুষ লিঙ্গ?  গালিব তাঁর এক ‘শের’-এ জবাব দেন, জনাব রথে যখন নারী আরোহন করেন তখন স্ত্রী লিঙ্গ আর পুরুষ চড়লে পুং লিঙ্গ। 

 

মির্জা গালিবের বন্ধু ও ভক্ত ছিলেন দিউয়ান ফজলুল্লাহ খাঁ। তিনি একদিন তাঁর গাড়িতে করে গালিবের বাড়ির পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করলেন অথচ গালিবের সঙ্গে দেখা করলেন না। এই ঘটনায় দুঃখ পেয়ে মির্জা তাঁকে চিঠি লিখে বললেন, বলেলন, এর থেকে বেশি অনুতাপ আমার আর কই হতে পারে, আপনি আমার বাড়ির পাশ দিয়ে আসা যাওয়া করলেন, কিন্তু আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আপনাকে একবারও সেলাম জানাতে পারলাম না। চিঠি পেয়ে ফজলুল্লাহ খাঁ এতটাই লজ্জিত হলেন যে তারপরই তিনি গালিবের বাড়িতে এসে হাজির হলেন। 

খাদ্য রসিক গালিবের খুব প্রিয় ছিল আম। একবার গালিব বাহাদুর শাহ জাফরের আম বাগানে গিয়ে দেখেন বাদশা বাগানে পায়চারি করছেন আর বাদশাহী আম দেখছেন। সেই আম বাদশাহী মহল ছাড়া কারো খাওয়ার অধিকার নেই। মির্জা সেই আমের দিকে একমনে তাকিয়ে৩ আছেন। বাদশা সেটা খেয়াল করে জিগ্যেস করলেন ‘মির্জা, এত মন দিয়ে কি দেখছো?’  মির্জা বললেন, শুনেছি এই আমে খাদকের এবং তার বাপ ঠাকুর্দার নাম লেখা থাকে। আমি দেখতে চাইছি কোন আমে আমার বাপ দাদার নাম লেখা আছে’। সমজদার মোগল বাদশা সেই দিনই এক টুকরি শাহী আম গালিবের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। 

একদিন সন্ধ্যায় গালিবের বন্ধু মির্জা সৈয়দ তাঁর বাড়িতে এসেছেন। আড্ডা ও পানাহার সেরে যখন মির্জা সৈয়দ বেরবেন তখন গালিব লন্ঠন নিয়ে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত এলেন; যাতে লন্ঠনের আলোয় সৈয়দ সাহেব জুতো পড়তে পারেন। গালিবকে এগিয়ে আসতে দেখে সৈয়দ সংকোচ বোধ করে বলএন, আপনি আবার কষ্ট করে এগিয়ে এলেন কেন? আমি নিজেই জুতো পরে নিতে পারতাম’। গালিব মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আরে  আমি আপনার জুতো দেখানোর জন্যে লন্ঠন আনিনি। আমি দেখতে এসছি, আমার নতুন জুতো জোড়া যাতে আপনার সঙ্গে চলে না যায়’।

 

শুধু কি কৌতুকবোধ, তাঁর অহংকার বোধ ছিল সাধারণের থেকে বেশি। ১৮৪২ সালে দিল্লী কলেজ স্থাপিত হলে সেখানে ফারসি ভাষার অধ্যাপক পদে মির্জা গালিবকে নিয়োগ করা হয়। মাসিক মাহিনা একশো টাকা। প্রথম দিন মির্জা গালিব পালকি চঁড়ে ভারত সচিবের অফিসের কাছে পৌঁছে সচিব সাহেবের কাছে তাঁর আগমন খবর পাঠান। সচিব খবর পেয়ে মির্জা গালিবকে ভিতরে আসতে বলেন। কিন্তু মির্জা পালকিতে বসেই অপেক্ষা করেন। কারণ প্রথা অনুযায়ী ভারত সচিব তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আসবেন। তা না হলে তিনি পালকি থেকে নামবেন না। বের হবেন।
সচিব বাইরে এলেন  কিন্তু অর্ভ্যথনা না জানিয়ে বললেন, ‘ মির্জা সাহেব, আপনি যখন গভর্নরের দরবারে আসবেন তখন আপনাকে অবশ্যই স্বাগত জানানো হবে। কিন্তু এখনতো আপনি চাকরি করতে এসেছেন। তাই এখন সেটা সম্ভব নয়’। সে কথা শুনে গালিব মৃদু হেসে বললেন, সম্মান বেশি পাব বলে অধ্যাপক হয়েছি। তার মানে  সম্মান বিকিয়ে দিতে আসিনি’। সচিব বললেন, ‘ আমি নিরুপায় মির্জা সাহেব, আপনাকে এই নিয়ম মানতে হবে। গালিব বললেন,  ‘দুঃখিত সচিব সাহেব, আমিও চললাম। এইভাবে চাকরি করতে পারবো না’। এ কথা বলে গালিব ফিরে যান। 

গালিব ৫০ বছর দিল্লিতে ছিলেন। মোগলদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু নিজের বসবাসের জন্যে একটি বাড়ি কেনেননি। সারা জীবন থেকেছেন ভাড়া বাড়িতে।সারা জীবন বহু বই পড়েছেন,  কিন্তু জীবনে তিনি একটি বইও কেনেননি। দিল্লির বইয়ের দোকান থেকে ভাড়ায় বই এনে পড়ার কাজটি সেরেছেন।

Share this article
click me!