দ্রৌপদী থেকে দুর্যোধন, প্রতিটি চরিত্রের মননের অন্দরমহলের খোঁজ দেয় নটধার মহাভারত

যুদ্ধ, পাশাখেলা, বা বস্ত্রহরণের মতো দৃশ্য কেমন হতে পারে সে ধারণা সকলেরই মাথার কোথাও না কোথাও অবস্থান করে। কিন্তু নটধা তাদের দৃশ্যকাব্যে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, ক্ষোভ, ক্ষমতা, অবদমন, যৌথতা এই বিষয়গুলিকেও নিখুত ভাবে প্রদর্শন করেছে। 

swaralipi dasgupta | Published : May 1, 2019 8:54 AM IST / Updated: May 01 2019, 05:36 PM IST

মঞ্চে বিভিন্ন রূপে নাট্য়ায়িত হয়েছে মহাভারত। বিভিন্ন দল বিভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে এই মহাকাব্য়কে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধর মতো ঘটনাগুলি। কিন্তু ‘নটধা’-র মহাভারতে কেন্দ্রে রয়েছে উদ্য়োগ পর্ব। মহাভারতের এই পর্বে তেমন নাটকীয় কোনও ঘটনা নেই বললেই চলে। কীভাবে পাণ্ডব ও কৌরবরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় এবং শান্তিদূত হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কীভাবে কৃষ্ণকেও এগিয়ে যেতে হয় যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে, তা-ই উদ্য়োগ পর্বের মূল বিষয়। এই পর্বে তেমন নাটকীয় মোড় না থাকলেও, যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে কোন চরিত্রের মননে কী রয়েছে তা উঠে আসে। 

যুদ্ধ, পাশাখেলা, বা বস্ত্রহরণের মতো দৃশ্য কেমন হতে পারে সে ধারণা সকলেরই মাথার কোথাও না কোথাও অবস্থান করে। কিন্তু নটধা তাদের দৃশ্যকাব্যে মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ঈর্ষা, ক্ষোভ, ক্ষমতা, অবদমন, যৌথতা এই বিষয়গুলিকেও নিখুত ভাবে প্রদর্শন করেছে। 

Latest Videos

যুদ্ধ হবে, নাকি হস্তিনাপুরে শান্তি বিরাজ করবে এই নিয়ে পাণ্ডব থেকে শকুনি প্রত্য়েকের মধ্যে চলা টানাপোড়েনকে যথাযথ নাট্যরূপ দিতে সার্থক নটধা। যুদ্ধ নিয়ে অনবরত বয়ে চলা দোলাচলের সঙ্গে প্রতিটি চরিত্রের যে ভিন্ন স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য রয়েছে তাও দেখানো হয়েছে। 

জনসমক্ষে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কতটা অপমানজনক তা সর্বজনবিদীত। তবে নটধার ‘মহাভারত’-এ দেখানো  হয় সেই বিভীষিকার মতো ঘটনা কীভাবে দ্রৌপদীর স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। আর সেই স্বপ্নের নির্যাস পাঞ্চাল-কন্য়ার মনের ভিতরেও যুদ্ধের বীজ পুঁতে দেয়। সেই বীজকে বড় করে তুলতে দ্রৌপদী অনবরত পাঁচ পাণ্ডবকে প্ররোচনা দিতে থাকে। কখনও রাগে, কখনও  ক্ষোভে, কখনও বা লাস্য়ে।

দেখা যায়, অর্জুন ও শুভদ্রা পুত্র অভিমণ্যু বীর যোদ্ধা হয়ে উঠলেও, সে যুদ্ধ চায় না। বরং উত্তরার সঙ্গে প্রেমে মেতে সে শান্তি বিস্তার করতে চায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে ধন্দে ভুগতে থাকে। যোদ্ধা যদি যুদ্ধ না করে তা হলে সে কী করবে? কীসের জন্য় তাকে সবাই মনে রাখবে? এই ধন্দ, সংশয়ে জর্জরিত হয়ে সে আত্মহননের দিকে এগোতেও উদ্য়ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরে আসে। কিন্তু সন্তানসম অভিমণ্যু কেন আত্মহত্য়া করল না, সেই আক্ষেপে নিজেকেই প্রশ্ন করে দ্রৌপদী। যুধিষ্ঠির- অর্জুনের দিকে প্রশ্ন ঠেলে দেয়- অভিমণ্যুর মৃত্যু হলে তো তারা ঘরে বসে থাকবে না! যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবে! এভাবেই নিজের অপমানের স্মৃতিকে চাগাড় দিয়ে মহাযুদ্ধ কামনা করতে থাকে দ্রৌপদী। 

কিন্তু কেন পাণ্ডবদের সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরী হলো। স্ত্রীর অপমানের পরেও কেন পাঁচ স্বামী শুধু অপেক্ষা করে গেল ও নীতির দোহাই দিল, সেই দিকটিও স্পষ্ট হয় এই নাটকে। দেখা যায় ছোট ভাই সহদেব যুদ্ধের দিকে পা বাড়ালেও, ধর্মের প্রতীক যুধিষ্ঠিরের দিকে সবাই মুখাপেক্ষী। কিন্তু স্ত্রীর অপমানে বাক্যব্যয় না করে, নীতির কথা বলে যুদ্ধকে এড়িয়ে গিয়ে কোথাও কি নিজের সিংহাসনের স্বপ্ন দেখে যুধিষ্ঠির? সেই প্রশ্নও বার বার ওঠে। 

একদিকে একদল যেমন নানা অছিলায় যুদ্ধ এড়িয়ে যায়, অন্যদিকে কৌরবদের প্রতীক দুর্যোধন ক্রমশ যুদ্ধের আফিম খাওয়াতে থাকে হস্তিনাপুরের প্রজাদের। বোঝাতে থাকে হস্তিনাপুরের প্রতি প্রেম থাকলে তাকে বাঁচাতে হবে। আর দেশপ্রেম মানেই কৌরবদের প্রতি দায়বদ্ধতা। মগজ ধোলাইয়ে ইতিবাচক সাড়া দেয় প্রজারাও। এই দৃশ্যটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে কতটা প্রাসঙ্গিক তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধের ঘোরে কীভাবে মানুষকে জড়িয়ে ফেলতে হয় সেই দৃশ্যটি নির্মাণের জন্য় কুর্ণিশ জানাতেই হয় পরিচালক অর্ণ মুখোপাধ্যায়কে। 

এই নাটকের খলনায়ক, অর্থাত্ দুর্যোধনই প্রধান চরিত্র।  কিন্তু দুর্যোধন কেন এত অন্ধকারাচ্ছন্ন চরিত্র তা-ও বেশ চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে এই নাটকে। যে সন্তানের বাবা অন্ধ এবং তাই মা স্বেচ্ছান্ধ, তার দৃষ্টিভঙ্গি যে অন্ধকারের দিকেই যাবে, তা-ই তো স্বাভাবিক। তাই যুদ্ধ ঘোষণার ঠিক আগে মা গান্ধারীর সঙ্গে তার কথোপকথনের দৃশ্যটি নাটকের অন্য়তম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দৃশ্যে এক জায়গায় রাগে অভিমানে দুঃখে দুর্যোধন গান্ধারীকে বলছে, আমার মৃত্য়ুর পরে একবার চোখ খুলে দেখো, তোমার সন্তানকে মানুষের মতোই দেখতে ছিল কি না। এখানে দুর্যোধনের শৈশব ও স্বেচ্ছান্ধ গান্ধারীর তরুণী অবস্থার একটি দৃশ্য় দর্শককে নতুন করে দুর্যোধনের চরিত্র বিশ্লেষণে বাধ্য করে। 

স্ত্রী ভানুমতীর সঙ্গে দুর্যোধনের অন্দরমহল দৃশ্যটিও একই ভাবে ভাবায়। দুর্বিনীত, অসভ্য়, স্বেচ্ছাচারী দুর্যোধন অনায়াসে বলে স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে বা অবদমন করে সে মেহনের আনন্দ লাভ করে। কিন্তু সেই একই দৃশ্যে দ্রৌপদীর প্রতি যে চরম অন্যায় হয়েছে তার জন্য় ক্ষমা চাইতে গিয়েও থেমে যায়। আটকে দেয় তার অহং বোধ এবং ভাই দুঃশ্বাসনের প্রতি অন্ধ স্নেহ। সেই স্নেহের জন্য়ই একদিন ভাইয়ের চরম অন্য়ায়ের প্রতিক্রিয়া নিতে বুক পেতে দিয়েছিল দুর্যোধন। কালিমালিপ্ত করেছিল নিজেকে। হয়ে উঠেছিল মহাভারতের খলনায়ক। 

নিজের লক্ষ্যে দুর্যোধন এতই স্থির যে, স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকা থেকে এসেও তাকে ভাঙতে পারেনি। কৃষ্ণ অনায়াসে দ্রৌপদীর চুড়িকে প্রেমের বার্তা হিসেবে পৌঁছে  দেয় কর্ণের কাছে। এমনকী, ‘ভানুমতী কেমন আছে’ এই এক বাক্য়ে দুর্যোধনের অহং-কে পথভ্রষ্ট করতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দান থেকে সে অনড়। আর তাই শেষ চেষ্টার পরে কৃষ্ণর মুখ দিয়ে দুর্যোধন-সহ কৌরবদের প্রতি বেরোয় অভিসম্পাত। যুদ্ধ ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে, বার বার দুর্যোধনকে বুঝিয়েছে শকুনি। নিজের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দুর্যোধনকে যুদ্ধ না করার অনুরোধ করেছে কর্ণ। কিন্তু কৃষ্ণ তাদেরকেও অভিসম্পাত করেছে, যেহেতু তারা কৌরব দলের। দলনীতি যে স্বয়ং কৃষ্ণের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়ায় তা ফুটে উঠেছে। মৃত্য়ু হবে জেনেও নিজের ভাষায় শান্তির দূতকে কথা বলতে দেখে দুর্যোধন যেন এখানেই অনেকটা এগিয়ে যায়। প্রমাণ হয়, যতই কৃষ্ণের শান্তির বার্তা থাক, যুধিষ্ঠিরের নীতিবোধ থাক, কর্ণের কৃতজ্ঞতা ও দায়বদ্ধতা থাক, প্রতিটি মানুষের মনের গভীর খনন করলে বেরিয়ে পড়ে এই দুর্যোধন। 
  

প্রসঙ্গ অভিনয়- 

দুর্যোধনের চরিত্রে রয়েছেন স্বয়ং নির্দেশক অর্ণ মুখোপাধ্য়ায়। চেনা গল্পকে নতুন করে ইন্টারপ্রিট করার শর্ত দেয় নটধার মহাভারত। শিব মুখোপাধ্য়ায়ের লেখা সংলাপের ঠাস বুনোটও সেই শর্ত পালন করে। খলনায়ককে নায়কের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে দুর্যোধনকে মানুষের মনে নতুন করে জায়গা দিয়েছেন অর্ণ। মঞ্চে যাঁরা সোহিনী সরকারকে দেখেননি, তাঁরা দ্রৌপদীর চরিত্রে বড়পর্দার নায়িকাকে দেখে পছন্দ করবেন। এই নাটকে দ্রৌপদী কমনীয় বা নমনীয় নয়। বরং আগ্রাসন ও প্রতিশোধস্পৃহাই বার বার দেখানো হয়েছে। আর তার সঙ্গে সোহিনী মানানসই। এ যুগের সঙ্গে যেভাবে এই মহাভারতকে মেলানো হয়েছে তাতে কৃষ্ণের চরিত্রে রুদ্ররূপ মুখোপাধ্য়ায় যথাযথ। এছাড়াও অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রত্য়েকেই নিজের মতো করে নজর কেড়েছেন।

এই মহাভারতের সবটুকুই নিজের মতো করে ইন্টারপ্রিট করার। চেনা গল্পকে নতুন করে আবিষ্কার করার। তবে তিন ঘণ্টার নাটকে বেশ কিছু জায়গা দৈর্ঘ্য়ে কিছুটা কমানো যেত। নাটকের আবহ সঙ্গীতও এ যুগের সঙ্গে মানানসই। এছাড়া মঞ্চ সজ্জা, কোরিওগ্রাফি ও আলোকসজ্জাও পুরো নাটকটির সঙ্গে সুবিচার করেছে। 

Share this article
click me!

Latest Videos

জঙ্গি গ্রেফতারে কড়া বার্তা মিঠুনের | Mithun Chakraborty #shorts #mithunchakraborty #shortsvideo
Viral Video! আবাসের টাকা ঢুকতেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাটমানি চাইছেন TMC কর্মী | Murshidabad Latest News
প্রেমের আড়ালে লক্ষাধিক টাকা লুঠ! প্রতারণার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর কাহিনি | South 24 Parganas News Today
ফিরহাদকে কড়া ডোজ দিলেন শুভেন্দু | Suvendu Adhikari #shorts #shortsvideo #suvenduadhikari #shortsfeed
ক্যানিং-এ এসে ভেবেছিল ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকবে! রাতেই গ্রেপ্তার কাশ্মীরি জঙ্গি | Canning News Today