তপন মালিকঃ বিউটি অফ দ্য বিউটি বলা হত তাঁকে। হলিউডের প্রথম দিকের সবথেকে জনপ্রিয় নায়িকা ছিলেন তিনি। নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত তিনিই ছিলেন দুনিয়ার সিনেমা দর্শকদের স্বপ্নের দেবী। অথচ মাত্র ৩৬ বছর বয়সে খ্যাতির চূড়ায় থাকার সময়েই সিনেমা জীবন থেকে বিদায় নিয়ে জনজীবন থেকে অন্তরালে চলে যান। কেন এমন সিদ্ধান্ত নিলেন তা আজও সিনেমা বোদ্ধাদের কাছে রহস্যময়। তবে তাঁর মৃত্যুর দু’যুগ পরেও সিনেমা প্রেমীরা তাঁর কথা ভুলতে পারেনি। গ্রেটা গার্বোর আসল নাম ছিল গ্রেটা লভিসা গুস্টাফসন। মাত্র ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত স্কুল গিয়েছিলেন। টুপি, চুলের ফিতে ইত্যাদি নানা পণ্যের দোকানে কাজ করতেন। এই সময় গ্রেটা কয়েকটি বিজ্ঞাপনে মডেল হন।
হঠাৎ একদিন সুইডিস ছবির পরিচালক এরিখ ফেসলারের চোখে পড়লেন। তাঁর বেশ কয়েকটি ছবিতে অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। গ্রেটার এই সময়টা কাটে সুইডেনের স্টকহোমে। এরপর পরিচালক মরিস স্টিলার তাকে হলিউডে নিয়ে যান। এমজিএম-এর ‘দি টরেন্টো’ ছবিতে অভিনয় করে বিপুল খ্যাতি লাভ করেন। ১৯২৪ সালে সুইডিশ চলচ্চিত্র দ্য সাগা অব গোস্তা বার্লিং আই আনা ক্রিস্টি দিয়ে অভিনয়ে অভিষেক তার। নির্বাক থেকে সবাক যুগে রেখেছিলেন অভিনয়-দক্ষতার ছাপ। ২১ বছরের মাথায় ১৯৪১ সালে মুক্তি পায় তার টু ফেসড ওম্যান চলচ্চিত্রটি। এরপর হঠাৎ-ই বিদায় জানালেন সিনেমা জগতকে। একই সঙ্গে বন্ধ করে দিলেন বাহিরের সঙ্গে যোগাযোগের সব জানালা, চলে গেলেন অন্তরালে। বয়স তখন সবে ৩৬, মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৮।
মারা যাওয়ার কয়েক বছর আগেও তিনি সকালে একটানা প্রায় এক ঘণ্টা ব্যায়াম ও জগিং করতেন। আর দিনে কয়েক মাইল পথ হাঁটতেন। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত আসেননি ক্যামেরার সামনে, কোনো সাংবাদিককেও দেননি ইন্টারভিউ, আর মৃত্যুর পরও মেলেনি কোনো ফটোগ্রাফ। তার এই অন্তরালই তাকে অমর করেছে। সিনেমা প্রেমীদের চোখে, মনে, এখনো সেই চিরযৌবনা, হাস্যোজ্জ্বল গ্রেটা গার্বো যার চেহারায় বার্ধক্যের কোনো দাগ নেই। তবে প্রশ্ন, জনপ্রিয়তা-যশ-খ্যাতি ছাপিয়ে কেন বেছে নিয়েছিলেন অন্তরালের জীবন? ১৯২৬ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত হলিউড ছিল তাঁর হাতের মুঠোয়। ১৯২৭ সালে ‘ফ্লেশ অ্যান্ড ডেভিল’ ছবিতে গ্রেটা গার্বো জন গিলবার্টের সঙ্গে জুটি বেঁধে সারা বিশ্বের দর্শকদের বুকে ঝড় তুলেছিলেন। ছবিতে অভিনয়ের সময় একে অপরের প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। গিলবার্ট গ্রেটার নিঃসঙ্গ জীবনে প্রেমের জোয়ার আনলেন।
অনেক দিন রাতে গিলবার্টের টাওয়ার রোডের বাড়িতে গ্রেটা অতিথি হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওদের সম্পর্কটা ভেঙে যায়। সুইডিশ সিনেমা নির্মাতা মরিস স্টিলার তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন গার্বোকে। তিনিই গার্বোকে হলিউডে নিয়ে এসেছিলেন। গিলবার্টের সঙ্গে গার্বোর প্রেমের খবর জানার পর লস অ্যাঞ্জেলেস ছেড়ে সুইডেনের স্টকহোমে চলে যান স্টিলার। কিছুদিন পর তিনি সেখানকার একটি হাসপাতালে মারা যান। সম্ভবত, এই কারণেই গ্রেটা গার্বো নীরবে সিনেমাকে বিদায় দিয়ে সঙ্গী করেছিলেন নির্জনতাকে। হলিউডে গ্রেট ষোল বছরের সিনেমা জীবনে ১১ বার বাড়ি বদল করেছেন। হলিউড ছেড়ে চলে যান সুইডেনে। সেখানে তার বিশাল বাড়ির বাইরে কদাচিৎ পা রাখতেন। সিনেমা লাইব্রেরি কিংবা পুরনো বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতেন। গ্রীষ্মে চলে যেতেন সুইজারল্যান্ডের ক্লোসটার্সে নিজ বাড়িতে। এ ভাবেই কেটে গেছে দশকের পর দশক; কিন্তু কখনই কোনো সাক্ষাৎর দেননি কোনো সাংবাদিককে।
পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকরা যা লিখেছিলেন তা বানিয়েই লিখতেন। গ্রেটা তা পড়ে নীরবে হাসতেন। গ্রেটার জীবনে মরিস স্টিলার, রিচার্ড শীল্ড, লিও কেন্ডি স্টোকে স্কি, সিসিন বীটন-সহ বহু খ্যাতনামা পুরুষ এসেছেন। কিন্তু জীবনে কাউকে স্বামী হিসেবে বেছে নিতে পারেননি। বার বার প্রেমে জড়িয়েও গ্রেটা বিয়েতে রাজি হননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বরাবর একটা কথাই বলেছেন, ‘নিঃসঙ্গ জীবন যত কষ্টকর হোক না কেন, আমার কাছে তা অত্যন্ত মধুময়’। শেষ জীবনে তিনি বহুবার বলেছেন : ‘অবচেতনভাবে আমি সর্বদা সুখের সন্ধান করেছি, কিন্তু সুখ কোথাও পাইনি। সুখি জীবন অন্তত আমার জন্যে নয়।’