২০০৮ সালে যখন আইপিএল শুরু হয় তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে এই প্রতিযোগিতা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞা বদলে দেবে। পরে সেই ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। নামি অনামি ব্যাটসম্যানরা আইপিএলে খেলেছেন এমন কিছু অনবদ্য ইনিংস যা আইপিএলের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। জেনে নিন এমনই কিছু দুর্দান্ত ব্যাটিং পারফরম্যান্স সম্পর্কে।
ব্রেন্ডন ম্যাকুলাম (১৫৮* বনাম রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর)
১৮ই এপ্রিল ২০০৮। আইপিএলের প্রথম ম্যাচ। সকলের মনেই প্রশ্ন যে এই টুর্নামেন্টের ভবিষ্যতটা কি। প্রথম ম্যাচেই টুর্নামেন্টের স্ক্রিপ্ট লিখে দিয়েছিলেন কিউয়ি উইকেট-রক্ষক। মাত্র ৭৩ বলে ১৫৮ রানের ইনিংস খেলে প্রথম ম্যাচেই বোলার-সংহার যজ্ঞের সূচনা করে দিয়েছিলেন ম্যাকুলাম। তার সেই মারাত্মক ইনিংসে ছিল ১০টি চার এবং ১৩ টি ছক্কা। প্রথম ম্যাচেই আইপিএলের রিংটোন সেট করে দিয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাকুলাম। দীর্ঘদিন ধরে এটিই ছিল আইপিএলে একজন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত স্কোর।
ক্রিস গেইল (১৭৫* বনাম পুনে ওয়ারীয়র্স ইন্ডিয়া)-
প্রত্যেকেই জানেন টি টোয়েন্টি ক্রিকেটের দৈত্য। কিন্তু তার এই ইনিংসটির সম্পর্কে কোনও রকম বিশেষণই কম পড়ে যায়। এই বিশেষ দিনে মাঠের ফিল্ডার, বোলার আর বাউন্ডারির দৈর্ঘ্যকে হাসির খোরাকে পরিণত করেছিলেন গেইল। তার এই ১৭৫ রানের রেকর্ড ভবিষ্যতে কেউ কোনওদিন ভাঙতে পারবেন কিনা সন্দেহ। তার ওই ইনিংসের দৌলতে ২৬৩ রান তুলেছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। মাত্র ৩০ বলে সেবার শতরান পূর্ন করেছিলেন গেইল। গোটা ইনিংসে মেরেছিলেন মোট ১৭টি ছয়। তার ওই ইনিংসকে সত্যিই লেখনীর মাধ্যমে ব্যক্ত করা যায় না। টি টোয়েন্টির ইতিহাসে এর চেয়ে বড় ধ্বংসাত্মক ইনিংস কেউ কোনওদিন আর খেলতে পারবেন কি?
শেন ওয়াটসন (১১৭ বনাম হায়দরাবাদ)-
আইপিএলের ফাইনালের ইতিহাসে সেরা ইনিংস। প্রথমে ব্যাট করে ধোনির চেন্নাইয়ের সামনে ১৭৯ রানের লক্ষ্য রাখে সানরাইজার্স হায়দরাবাদ। প্রথম ১৫ বলে ৫ রানও না করতে পারা ওয়াটসন পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভার থেকে ধারণকরেন সংহারমূর্তি। ৮ টি ছক্কা ও ১১ টি চার সহযোগে একসময় অসম্ভব মনে হওয়া টার্গেট ২০ ওভার শেষ হওয়ার আগেই তুলে নেয় চেন্নাই। আইপিএল ফাইনালে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত রানের রেকর্ড গড়েন ওয়াটসন। তার ১১৭ রান আসে মাত্র ৫৭ বলে।
ঋদ্ধিমান সাহা (১১৫* বনাম কলকাতা নাইট রাইডার্স)-
আইপিএল ২০১৪-র ফাইনালে সেই টুর্নামেন্টের দুই সেরা দল কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে রীতিমতো বিপাকে পড়ে গিয়েছিলো প্রীতি জিন্টার দল। গত ম্যাচের শতরানকারী বীরেন্দ্র সেওবাগ ও অধিনায়ক বেইলিকে পাওয়ার প্লে-তেই হারিয়ে ফেলে ধুঁকছিলো তারা। সেই সময় মনন ভোরার সাথে মিলে দলের হাল ধরেন ঋদ্ধিমান। সেই টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ট বোলিং আক্রমণকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন তিনি। তার ব্যাটের তান্ডবের সামনে উড়ে যান পীযূষ চাওলা, সুনীল নারিন, মর্নি মর্কেল-রা। সুনীল নারিন-কে ছয় মেরে আইপিএলের ফাইনালের ইতিহাসের প্রথম শতরানটি করেন তিনি। যদিও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব ম্যাচ ন জিততে পারায় তার ওই ইনিংসটি নিয়ে বেশি আলোচনা হয় না। তবু নিঃসন্দেহে বলা যায় আইপিএল ফাইনালে কোনও ভারতীয়র খেলা সেরা ইনিংস হলো বঙ্গ উইকেটকিপারের এই শতরান।
বীরেন্দ্র সেওবাগ (১১৯* বনাম ডেকান চার্জাস)-
আইপিএল ৫-এ বাজে ফর্মে থাকা ডেকান চার্জাসের বিরুদ্ধে ১৭৬ রান তুলতে গিয়ে ছয় ওভারে মাত্র ২৫ রানে তিন উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল সেওবাগের দিল্লি ডিয়ারডেভিলস। কিন্তু ডেকানের জয় এর রাস্তায় বুক চিতিয়ে দাঁড়ান সেওবাগ। ইশান্ত শর্মা, ডেল স্টেইন, অমিত মিশ্রা সমৃদ্ধ বোলিংয়ে কচুকাটা করেন নজফগড়ের নওয়াব। নকআউটে যেতে গেলে জিততেই হতো দিল্লি কে। সেওবাগের অসাধারণ শতরান সেই লক্ষ্য নিশ্চিত করে। একার হাতে ডেকান চার্জাসকে হারিয়ে দিল্লিকে জয় এনে দেন তিনি।
ডেভিড মিলার (১০১* বনাম রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর)
প্রথমে ব্যাট করে পাঞ্জাবের সামনে ১৯১ রানের লক্ষ্য রাখে বিরাট কোহলির দল। রান তাড়া করতে নেমে ১০ ওভারে মাত্র ৬৪ রান তুলে ৪ উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকছিল পাঞ্জাব। এই অবস্থায় ব্যাট করতে নামেন ডেভিড মিলার। প্রথমেই তার ক্যাচ ফেলেন বিরাট কোহলি। তারপরে শুরু হয় মিলারের তান্ডব যার ফলে তার নামই হয়ে যায় কিলার মিলার। প্রত্যেক বোলারের ডেলিভারিকে মাঠের বাইরে পাঠাতে থাকেন তিনি। শেষ ১০ ওভারে ১৩০ রান তুলতে হতো পাঞ্জাবকে। মিলারের তান্ডবে মাত্র ৮ ওভারেই সেই রান তুলে ফেলে তারা। ৩৮ বলে ১০১ রান করে অপরাজিত থাকেন মিলার।
এ বি ডিভিলিয়ার্স (৪৭* বনাম সানরাইজার্স হায়দরাবাদ)-
এই ইনিংসটিকে তালিকায় দেখে অনেকেই চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু রানের পরিমাণের জন্য না, এই ইনিংসটি তালিকায় রাখা হয়েছে কোন পরিস্থিতিতে কোন বোলারের বিরুদ্ধে এই রান করা হয়েছে তা দেখে। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে জিততে গেলে কোহলির দলকে ১৮ বলে ৩৮ করতে হতো। তখনও দু ওভার বাকি ছিল ডেল স্টেইনের। ওই ম্যাচে তখনও অবধি তার পরিসংখ্যান ছিল ২-১-৭-১। তার মধ্যেই স্টেইনের ওভার খেলতে প্রস্তুত ছিলেন ডিভিলিয়ার্স। ১৮ তম ওভারে স্বদেশীয় বোলারকে কচুকাটা করেন তিনি। ৩৮ রানের মধ্যে ২৩ রানই ওই ওভার থেকে তুলে নেন তারা। সেই সময় বিশ্বের সেরা বোলারকে একাধিক বার স্কুপ করে গ্যালারিতে ফেলেন এবি। ওভার শেষ করে নিজেই এগিয়ে এসে মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি-কে জড়িয়ে ধরেন তিনি। ডিভিলিয়ার্সের তান্ডবে এক ওভার বাকি থাকতেই প্রয়োজনীয় রান তুলে ফেলে আরসিবি। ওই পরিস্থিতি ডিভিলিয়ার্সের ওই অপরাজিত ৪৭ অনেক শতকীয় ইনিংসের থেকে বেশি দামি।
বিরাট কোহলি (১০৯ বনাম গুজরাট লায়ন্স)-
২০১৬ সালের ১৪ মে, ঘরের মাঠে এম চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে হওয়া আইপিএল ম্যাচে গুজরাত লায়ন্সের বিরুদ্ধে অবিস্মরণীয় জয় পেয়েছিল রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর। সৌজন্যে অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও এবি ডিভিলিয়ার্সের অনবদ্য পার্টনারশিপ। আটটি ছক্কা ও পাঁচটি চার সহকারে ৫৫ বলে ১০৯ রান করে আউট হয়েছিলেন বিরাট। প্রথমে আস্তে খেলেছিলেন বিরাট। সুযোগ করে দিচ্ছিলেন এবি-কে বেশি স্ট্রাইক নেওয়ার। ১৬ ওভার শেষে তার রান ছিল ৫১। তার পরবর্তী ১৩ বলে নিজের সেঞ্চুরি সম্পন্ন করেন বিরাট। এর থেকেই বোঝা যায় সেই মুহূর্তে কতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
বীরেন্দ্র সেওবাগ (১২২* বনাম চেন্নাই সুপার কিংস)-
সপ্তম আইপিএলের প্রথম কোয়ালিফায়ারে মুখোমুখি হয়েছিল চেন্নাই এবং পাঞ্জাব। পাঞ্জাবের মরশুমটা খুব ভালো কাটলেও ছন্দে ছিলেন না ওই বছরেই পাঞ্জাবে যোগ দেওয়া বীরেন্দ্র সেওবাগ। ভালো শুরু করেও বড় রান করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন তিনি। প্রথম কোয়ালিফায়ার খেলতে নামার আগে তার বাবার ব্যাটিং নিয়ে অভিযোগ তোলেন সেওবাগের বড় ছেলে। সেওবাগ মাঠে নামার আগে তাকে বলে যান তিনি প্রমান করবেন যে তিনি কেমন ব্যাটসম্যান। তারপর বাকিটা ইতিহাস। ব্যাট হাতে ধ্বংসলীলা চালান সেওবাগ। একমাত্র ঈশ্বর পান্ডে ছাড়া চেন্নাইয়ের প্রত্যেক বোলারের ইকোনমি ছিল ১১ এর ওপরে। ১২ টি চার, ৮ টি ছক্কা সহযোগে মাত্র ৫৮ বলে ১২২ রান করেন তিনি। ওই ইনিংসের সৌজন্যে ২২৬ রান তোলে পাঞ্জাব।
সুরেশ রায়না (৮৭ বনাম কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব)-
আইপিএল সাতের কোয়ালিফায়ারে পাঞ্জাবের ২২৭ রান তাড়া করতে গিয়ে ১ রানে তাদের প্রথম উইকেট হারিয়েছিল চেন্নাই। তারপর ব্যাট করতে আসেন রায়না। পাঞ্জাব বোলারদের রীতিমতো খুন করতে থাকেন তিনি। তার দাপটে মাত্র ৬ ওভারে ১০০ রান তোলে চেন্নাই। ১২ টি চার ও ছয়টি ছক্কা সহযোগে ২৫ বলে ৮৭ রান করে রায়না রান-আউট হন। ম্যাচ চেন্নাইয়ের হাতের মুঠোয় এনে দিলেও। ম্যাকুলাম এবং ধোনির স্লো ব্যাটিংয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যাচ জিতে নেয় পাঞ্জাব। সেদিন রান-আউট না হলে আইপিএলের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ডটি নিজের নামে করে নিতে পারতেন রায়না।
ইউসুফ পাঠান (১০০ বনাম মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স)-
ওয়াংখেড়ের পাটা উইকেটে প্রথমে ব্যাট করে রাজস্থান রয়েলসের সামনে ২১৩ রানের লক্ষ্য রাখে সচিনের মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। রান তাড়া করতে নেমে ১০ ওভারে ৪ উইকেট খুইয়ে ৬৬ রান তুলে ধুঁকছিল রাজস্থান। এই সময় শুরু হয় পাঠান ঝড়। ৯টি চার ও ৮ টি ছক্কা সহযোগে ৩৭ বলে শতরান করেন ইউসুফ পাঠান। প্রায় ম্যাচ মুম্বাইয়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রান আউট হয়ে যান তিনি। মাত্র ৪ রানে জয় পায় মুম্বই।
এবি ডিভিলিয়ার্স (৭৯ বনাম গুজরাট লায়ন্স)-
সম্ভবত আইপিএল প্লে অফের ইতিহাসে সবথেকে দায়িত্বশীল ইনিংস। গুজরাট লায়ন্সের ১৫৯ তাড়া করতে নেমে একসময় ২৯ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল ব্যাঙ্গালোর। ঠান্ডা মাথায় স্টুয়ার্ট বিনি-কে সঙ্গী করে ইনিংস সামলানো শুরু করেন এবি ডিভিলিয়ার্স। প্রথমে রক্ষণাত্মক খেলে ক্রমে বোলারদের আক্রমণ করা শুরু করেন তিনি। বিনি আউট হলে ইকবাল আব্দুল্লা-কে সঙ্গী করে আরসিবি-কে পৌঁছে দেন জয়ের লক্ষ্যে। প্রমান করে দেন পরিস্থিতি যত ভয়ংকরই হোক না কেন ডিভিলিয়ার্স যতক্ষণ মাঠে আছেন জয়ের আশাও ততক্ষণ টিকে থাকে।
আড্যাম গিলক্রিস্ট (৮৫ বনাম দিল্লি ডেয়ারডেভিলস)-
২০০৯ আইপিএলে দুর্ধর্ষ ফর্মে থাকা দিল্লি সেমিফাইনালে মুখোমুখি হয় ডেকান চার্জাসের। দিল্লির ১৫৪ রান তাড়া করতে নেমে প্রথম দশ ওভারেই খেলা অর্ধেকের বেশি শেষ করে দেন ডেকান অধিনায়ক এবং ওপেনার আড্যাম গিলক্রিস্ট। মাত্র ৩৫ বলে ৮৫ রান করে তিনি যখন আউট হন তখন বাকি দশ ওভারে চার্জাসকে জিততে হলে তুলতে হতো মাত্র ৫২ রান। সেই ইনিংসের ওপর ভর করেই ফাইনালে পৌঁছে ট্রফি ঘরে তোলে চার্জাসরা।