কোথাও দোল-আবার কোথাও নাম হোলি, কোন রাজ্যে কী নামে পরিচিত রঙের এই উৎসব
কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারী মহাসমারোহে পালিত হয় দোল উত্সব বা হোলি। এ দিন রঙের খেলায় মেতে ওঠে ভারতের প্রায় সব প্রদেশ। লোক সংস্কৃতি আর গল্পকাহিনির মিশেলে আনন্দ করার সেরা দিন বোধহয় এই দিনটাই। দোলের রঙের সঙ্গেই অঞ্চল বিশেষে নাম আলাদা হলেও প্রাণের আনন্দ সবজায়গাতেই এক।
Tapan Malik | Published : Mar 10, 2020 11:21 AM IST
খাড়ি হোলি – উত্তরাখণ্ডের কুমায়ুনে হোলি উৎসবের নাম খাড়ি হোলি। এখানকার লোকেদের কাছে খাড়ি ছারাও হোলি বৈঠকি হোলি বা মহিলা হোলি নামেও সমধিক পরিচিত। খাড়ি হোলিতে কুমায়ুনিরা পরস্পরের মধ্যে রং আদান প্রদান যেমন করে পাশাপাশি একসঙ্গে নাচ গান করে। আসলে ওদের কাছে এই খাড়ি হোলি হল এক জায়গায় জড়ো হওয়া, মেলামেশা এবং নিজেদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে মান্যতা দেওয়া। খাড়ির বিশেষত্ব হল ছেলেমেয়েরা কুমায়ুনের ঐতিহ্য অনুসারী পোষাক লোক গান গায় আর সেই গানের তালে দল বেঁধে নাচ করে। এছাড়া আছে বৈঠকি হোলি, তাতে এক জায়গায় বসে হয় বৈঠকি গানের আসর। আবার মহিলা হোলি তাতে কেবলমাত্র মহিলারাই অংশগ্রহণ করে।
হোলা মোহল্লা – পশ্চিমবঙ্গের দোল খেলার সঙ্গে পাঞ্জাবের হোলা মোহল্লার ঢের ফারাক। দোল বা হোলি উৎসব উপলক্ষে পাঞ্জাবের হোলা মোহল্লা দু’চোখ মেলে দেখার মতো ব্যাপার। পঞ্জাবের আনন্দপুর সাহিবে হোলির পরের দিন পালন করা হয় হোলা মহল্লা। গুরু গোবিন্দ সিং এই মেলার প্রচলন করেছিলেন। সেই প্রথা মেনে এখনও মেলা বসে। তিনদিন ধরে চলে উত্সব। শিখরা এই সময় ঘোড়ায় চড়ে নাটকীয় যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে। এটা এক ধরণের মার্শাল আর্ট। গুরুগ্রন্থ সাহিব থেকে কীর্তনও গাওয়া হয়। শেষ দিন তখত কেশগড় সাহিব থেকে বের হয় লম্বা মিছিল। কিলা আনন্দগড়, লোহগড় সাহিব, মাতা জিতোজির মতো শিখদের পাঁচটি ধর্মীয় জায়গা ধরে ওই যায় মিছিল। এইসময় আশেপাশের গ্রামের মানুষদের গমের আটা, চাল, সব্জি, দুধ ও চিনি দেওয়া হয়।
ইয়াওসাং – মণিপুরের হোলির নাম ইয়াওসাং। এই উপলক্ষ্যে বাঁশের ছোটো কুঁড়ে ঘর বানানো হয়। তাতে শ্রীচৈত্যের জন্মদিন পালন করা হয়। পুজো করা হয়। তার পর থাবাল চোংবা মানে একটা আঞ্চলিক লোক নাচ পরিবেশন করা হয়। তারপর শুরু হয় রঙের খলা। ইয়াওসাং পালিত হয় দোল পূর্ণিমা থেকে শুরু করে পরবর্তী ছয় দিন ধরে। দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন- এর প্রতীক হিসেবে এখানে এই ইয়াওসাং হোলি পালিত হয়ে আসছে বহু কাল ধরে।
লাঠমার-ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় হোলি উৎসব হয় বরসনে। বরসন শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থান। বরসনে হোলি বা দোল লাঠমার নামেই পরিচিত এবং প্রচলিত। লাঠ মানে লাঠি। যেটা হোলির সারা দিনই রঙের সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের হাতে থাকে। ভাবছেন তো দোল খেলতে লাঠি আবার কী হয়? আসলে এখানকার একটা প্রথা অনুযায়ী মহিলারা লাঠি নিয়ে পুরুষদের তাড়া করে। তা বলে এমন ভাববেন না যে লাঠি পেটা করা হয়। এটা একটা প্রথা মাত্র। মহিলারা শ্রীকৃষ্ণের পৌরানিক গোপিনীদের মতো সাজেন আর পুরুষরাও সেই মতোই বেশভূষা পড়েন। এখানকার রাধারাণি মন্দির থেকে খেলা শুরু হয়। উত্তরপ্রদেশের বরসনা, বৃন্দাবন, মথুরা, নন্দগ্রামে এই রীতি মেনেই হোলি খেলা হয়ে আসছে এখনও। নন্দগাঁওয়ের ছেলেরা বরসনের মেয়েদের সঙ্গে হোলি খেলতে আসে। মেয়েরা রঙের বদলে লাঠি নিয়ে অভ্যর্থনা জানায় তাদের। পরের দিনটা থাকে ছেলেদের জন্য। এদিন বরসনের ছেলেরা রঙ মাখাতে যায় নন্দগাঁওয়ের মেয়েদের। একইভাবে নন্দগাঁওয়ের মেয়েরাও বরসনের ছেলেদের লাঠি নিয়ে তাড়া করে।
রাজকীয় হোলি – রাজস্থানের রয়্যাল হোলিতে বসন্তের প্রাণোচ্ছ্বলতা প্রকাশিত হয় একেবারে রাজকীয় ঢঙে। চন্দ্রের পূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশের দিন মরুদেশে সকলে মিলে একত্রিত হন রঙিন হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষায়। বনফায়ার করে সূচনা করা হয় হোলির। তারপর জল আর আবির দিয়ে একে অপরকে রঙ মাখানোর আনন্দে মেতে ওঠেন সকলে। উদয়পুরে বিশাল বড়ো শোভাযাত্রা করা হয়। শোভাযাত্রা শেষ হলে তার পর হোলিকা দহন করা হয়। তার পর রঙের খেলা।
ফাকুওয়া – আসমে হোলির নাম ফাকুওয়া। এখানের হোলি পশ্চিমবঙ্গের হোলির মতোই পালন করা হয়। আগের দিন হোলিকা পোড়ানো হয়। পরের দিন রঙের উৎসব। ফাগুয়া – বিহারের ফাগুরার কথা অনেকেই জানি। এখানেও ব্রজধামে রাধাকৃষ্ণের প্রেম ভালোবাসার কথা মনে করেই হোলি খেলা হয়। রং খেলার পর গাওয়া হয় আঞ্চলিক গান। ফাল্গুন মাসে হয় বলে ফাগুয়া নামে পরিচিত। ফাগুয়া একটা ভোজপুরি শব্দ।
রং পঞ্চমী – মহারাষ্ট্র আর মধ্যপ্রদেশে দোল উৎসব রং পঞ্চমী নামে বিখ্যাত। সিনেমার পর্দায় এই রং পঞ্চমীর অনেক দৃশ্যই অনেকে দেখেছে। মানুষের পিরামিড তৈরি করে। অনেক ছেলে মিলে গোল করে দাঁড়ায়। তাদের পিঠের ওপর কিছু, তারও ওপর কিছু এই ভাবে মানুষের মই বানিয়ে অবশেষে এক জন সব থেকে ওপরে উঠে উঁচুতে বাঁধা দই-এর হাঁড়ি ভাঙে। হোলিকা দহনের পাঁচ দিন পরে হোলি খেলা হয়।
সিগমো – ছোট্টো রাজ্য গোয়ার হোলি উৎসবের নাম সিগমো। এটি শিশিরোৎসব নামেও পরিচিত। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমার দিন মানে দোলের দিন একগানকার কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক করে নাচ গান করে। এই প্রথা চলে আসছে বহু যুগ যুগান্তর ধরেই। এই উৎসবে শামিল হন বহু পর্যটকও।
মাঞ্জাল কুলি – উত্তর ভারতে হোলির যতটা চল আছে দক্ষিণ ভারতে ততটা নয়। তবুও কিছু কিছু এলাকায় হোলি পালন করা হয়। কেরালার এই উৎসব মাঞ্জালা কুলি নামে পরিচিত। গোসরপুরম তিরুমালার কঙ্কনি মন্দিরে এই উৎসবের সূচনা হয়।
দুলন্দি- হরিয়ানায় দোল উত্সবের নাম দুলন্দি হোলি। হোলির সারাদিনই এখানে বৌদি আর দেওরের মধ্যে খুনসুটি চলে। এইদিন বৌদিরা খেলার ছলে যত খুশি দেওরদের পেটাতো পারে। তাদের শাড়ি পেঁচিয়ে দেওরের হাত পা বেঁধে ফেলে। সন্ধেবেলা বৌদিদের জন্য দেওররা মিষ্টি নিয়ে আসে। রাস্তার মাঝখানে উঁচু দড়িতে টাঙানো মাখনের হাঁড়ি ভাঙার রেওয়াজও চলে এখানে।
রঙ্গপঞ্চমী-মহারাষ্ট্রে দোল উত্সবকে বলে রঙ্গপঞ্চমী। পাঁচদিন ধরে হোলি পালন করা হয় এখানে। পঞ্চম দিনে আবির ও রং খেলা হয়। কোথাও কোথাও দোলকে শিমগা বা শিমগোও বলা হয়ে থাকে। মহারাষ্ট্রের মত্সজীবী সম্প্রদায়ের মধ্যে হোলি খুবই জনপ্রিয়। নাচ, গান ও বিভিন্ন রকম কৌতূকের মধ্যে হোলি পালিত হয় এখানে।