'ধর্ম'-যুদ্ধ, বিজেপির চক্রবূহে ফেঁসে গিয়েছেন মমতা - এবার দুই কূলই না হারাতে হয়

২০২১ সালের বাংলার বিধানসভা নির্বাচন শুধু 'মমতা বনাম মোদী' নয়। বরং 'রাম বনাম দুর্গা-কালী'ও বলা যেতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বিরুদ্ধে তুষ্টিকরণের অভিযোগ এনেছে বিজেপি। আর তার মোকাবিলায় এখন পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতা। নির্বাচনের আগে উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দুর্নীতি সব বিষয় পিছনে চলে গিয়ে ধর্মীয় স্লোগান এবং মন্দির ভ্রমণই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, তাঁকে 'ভেজাল হিন্দু' বলেছেন নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী শুভেন্দু অধিকারী। গেরুয়া রঙের প্রতিযোগিতায় কি বিজেপিকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? নাকি এই কাজ করতে গিয়ে একূল ওকূল দুই হারাবেন তিনি?

 

amartya lahiri | Published : Mar 17, 2021 9:42 AM IST / Updated: Mar 22 2021, 02:26 PM IST
18
'ধর্ম'-যুদ্ধ, বিজেপির চক্রবূহে ফেঁসে গিয়েছেন মমতা - এবার দুই কূলই না হারাতে হয়

হিন্দু ব্রাহ্মণ মমতা

ভোটগ্রহণ পর্ব শুরুর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। এই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যান্য প্রার্থীরা দারুণভাবে বিজেপির 'হিন্দুত্ব তাস'-এর মোকাবিলা করার চেষ্টা করছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে সংস্কৃত শ্লোক বলছেন,  নিজেকে 'হিন্দু মেয়ে', 'ব্রাহ্মণ', তাঁর পদবী বন্দ্যোপাধ্যায় - এইসব ঘোষণা করছেন। 'লা ইলাহি' শোনা যাচ্ছে না। বলছেন চন্ডিপা করে তবে বাড়ি থেকে বের হন। শুধু তিনিই, তাঁর বিধায়করা স্থানীয় মন্দিরগুলিতে পূজা দিচ্ছেন। ধর্মীয় সংস্থাগুলিতে অনুদান দিচ্ছেন। এলাকায় যত মন্দির আছে চষে ফেলছেন।

28

হিন্দু-বিরোধী মমতা

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ভিডিওটি - একদল বিজেপি সমর্থক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কনভয় লক্ষ্য করে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছে, আর পরক্ষণেই গাড়ি থামিয়ে তাদের দিকে তেড়ে গিয়ে মমতা বলছেন 'এত সাহস গালি দিচ্ছিস'! এই ঘটনাটা ছিল তার কয়েক মাস আগে থেকে বাংলায় তৈরি হয়ে যাওয়া একটি অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক ভাষ্যের বহিপ্রকাশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে একটানা সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ করে করে একটা জায়গা তৈরি করেই ফেলেছিল বিজেপি। তাতে, ঘি ঢেলেছিল ওই ঘটনা। ২৩ জানুয়ারি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে নেতাজির জন্মদিনে জয়শ্রীরাম স্লোগান যতই কুরুচিকর হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের বক্তব্য না রাখা কিন্তু, এই আবেগকেই ফের সুড়সুড়ি দিয়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে মহরমের দিন দুর্গা প্রতিমা ভাসান বন্ধ রাখা, মৌলবি ভাতার মতো পদক্ষেপগুলি।

38

নরম হিন্দুত্ব
 
বিজেপির কড়া হিন্দুত্বের বিরোধিতা করতে নরম হিন্দুত্বের তাস যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম ফেললেন, তা নয়। 'নরম হিন্দুত্ববাদ' নীতি অবলম্বন করার চেষ্টা বারবার করেছে কংগ্রেস। একের পর এক রাজ্যের বিধানসভা ভোট, কিংবা লোকসভা নির্বাচনের আগে স্থানীয় প্রত্যেকটি মন্দিরে মন্দিরে ঘন্টা বাজিয়েছেন  রাহুল গান্ধী। তাঁকে বলতে হয়েছে তিনি শিবের উপাসক। অবশ্য বিশেষ কাজ দেয়নি সেই কৌশল। তবু, একই পথ আঁকড়ে রয়েছে কংগ্রেস। নরম হিন্দুত্বের চাষ করচেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালও। এখনও পর্যন্ত লাভ-ক্ষতির হিসাবে তেমন প্রভাব পড়েনি।

48

দোটানায় আটকে কংগ্রেস

আসলে, কংগ্রেস বা অন্যান্য মধ্যপন্থী দলগুলি বিজেপির মোকাবিলা করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্প্রদায়িকতার এক অদ্ভূত দোটানায় আটকে গিয়েছে। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সাফল্য যেমন তাদের প্রলুব্ধ করছে, স্থানীয় স্তরে নামতে হচ্ছে প্রতিযোগিতায়। তেমনই বিজেপির সঙ্গে নীতিগত তফাৎ রাখতে গিয়ে মুখে আওড়াতে হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি। আর এই দ্বন্দ্ব-দ্বিধার পাকদন্ডির থেকে ভারতের মানুষ এই মুহূর্তে বিজেপি বা আসাদুদ্দিন ওয়াইসির একবগ্গা মনোভাব, সাম্প্রদায়িক-জাতিয়তাবাদ বেশি মনে ধরছে।

 

58

বাঙালি উপ-জাতীয়তাবাদ

তবে এই ক্ষেত্রে তৃণমূল আঞ্চলিক দল হিসাবে একটি ভাল নীতি নিয়েছে। তা হল, বাঙালি উপ-জাতীয়তাবাদকে তারা বিজেপির সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে ঢাল হিসাবে তুলে ধরেছে। ফলে বিজেপিও যে বাঙালিয়ানার প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়েছে, এটাই এই নীতির সাফল্য। শ্রীরাম-এর পাল্টা হিসাবে ঘাসফুল শিবির তুলে ধরেছে মা দুর্গা, মা কালীর মতো স্থানীয় প্রাসঙ্গিক দেবদেবীদের। বস্তুত বাংলাায় বছর খানেক আগেও 'জয় শ্রী রাম'-এর থেকে জয় কালী বা জয় মা দুর্গাই বেশি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল। তবে সেইসব ছিল ধর্মীয় স্লোগান, রাজনৈতিক নয়। বিজেপির স্থানীয় কর্মীরাই বলেন, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসাবেই তাঁরা জয়শ্রীরাম ধ্বনি তুলতে শুরু করেছিলেন। বর্তমানে কিন্তু, তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কাজেই জয়শ্রীরাম স্লোগানকে আর বহিরাগত বলা যাবে না।

68

হাওয়া নয়, ঝড় চায় বিজেপি

এই হাওয়াকে একেবারে ঝড়ে পরিণত করতে বর্তমানে উঠেপড়ে লেগেছেন বিজেপি নেতারা। মা দুর্গা, মা কালী, শ্রীকৃষ্ণের ছোট-বড়-মাঝারি - প্রতিটি মন্দিরই তাঁরা দর্শন করছেন, স্বল্প-পরিচিত মন্দিরগুলিকেও অন্য় উচ্চতায় তুলে ধরছেন। সম্প্রতি দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির এবং কলকাতার কালীঘাটের মন্দিরকে সংযুক্ত করা নতুন মেট্রোরেল পথেরও সূচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর এই কেকের উপর চেরি হিসাবে কাজ করছে, ঠিক ভোটের আগে, ক্ষমতায় আসলে রাজ্যে 'লাভ জিহাদ' আইন প্রণয়নের ইঙ্গিত। আর এই হিন্দুত্বের প্রচারে বাংলায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে হিন্দুত্বের পোস্টার বয়, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাতকে। এমনকী নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর হয়েও প্রচারে আসবেন তিনি।

78

জাতাকলে মমতা

এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পড়েছেন জাতাকলে। বর্তমানে '৭০ শতাংশে'র মধ্যে তৃণমূলের ভোট ধরে রাখতে গেলে তাঁকে প্রথমে 'সংখ্যালঘু তোষণের' অভিযোগের মোকাবিলা করতে হবে। বর্তমানে এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা। স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতির শিকার হওয়া ভোটারদের কাছে কিন্তু, বিজেপির এই ভাষ্য বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। বলে মনে হয়। অন্যদিকে, তাঁর বর্তমানে হিন্দু হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করার, বিজেপি নেতাদের থেকে পবিত্রতর প্রমাণ করার উদগ্র প্রচেষ্টা ধাঁধায় ফেলেছে বাকি ৩০ শতাংশকেও। আর এরই মধ্যে উঠে এসেছেন আব্বাস সিদ্দিকি।

88

আব্বাস, অশনি সংকেত

একেবারে টেলিভিশনের পর্দায় বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ করেছেন ফুরফুরা শরীফের পীরজাদা তথা আইএসএফ দলের প্রতিষ্ঠাতা আব্বাস সিদ্দিকী। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, হিন্দু হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার অভিনয় করলেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ দেওয়া যায় না। প্রশ্ন করেছেন, মুসলিম সমাজের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি এতই উন্নয়ন করে থাকেন, তাহলে এখনও মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়েনি কেন, কেন মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষক নিয়োগ হয় না, কেন কাজ নেই মুসলমান যুবকদের হাতে? দক্ষিণবঙ্গে সংখ্যালঘু সমাজে কিন্তু এই ফুরফুরা শরীফ ও আব্বাস সিদ্দিকীর দারুণ প্রভাব। কাজেই বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে, শেষে একূল ওকূল - দুই কূলই না চলে যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

Share this Photo Gallery
click me!

Latest Videos

Recommended Photos