২৬/১১-র জঙ্গি দমনে ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার একটি দল, প্রাণ বেঁচেছিল ১৫০ জনের

  • ২৬/১১-র ১১ বছর পূর্তিতে আরও এক ঘটনাকে ফিরে দেখা
  • কীভাবে নিজেদের জীবন বিপন্ন করেছিলেন একদল বিদেশি 
  • এদের হাতে প্রাণ বেঁচেছিল ১৫০ জনের 
  • কেমন ছিল সেই ভয়ানক রাত, সেই কাহিনি এখন সামনে

Asianet News Bangla | Published : Nov 26, 2019 6:38 AM IST / Updated: Nov 26 2019, 12:25 PM IST

ডেজার্টের লোভে দলটি বসেছিল। দলের নেতা বব নিকোলস এবং তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও চার সঙ্গী। তাজ হোটেলের একদম ছাদের উপরে রেস্তোরাঁ, যার নাম হল শোয়াক। সেখানেই বসে দলটি অপেক্ষা করছিল ডেজার্টের। বব একটা সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার দেহরক্ষী হিসাবে কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে একটি সিকিউরিটি এজেন্সি খোলেন তিনি। যার ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে আমেরিকা, দুবাই থেকে শুরু করে ভারত ও ফ্রান্সে। মূলত সেলিব্রিটি এবং স্পোর্টস ইভেন্টে-র জন্য নিরাপত্তারক্ষী সরবরাহ করে থাকে ববের এজেন্সি।  ২০০৮ সালে ভারতে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নিরাপত্তার দায়িত্বও পেয়েছিল এই এজেন্সি। সেই জন্যই মুম্বই এসেছিলেন ববরা। বিসিসিআই-এর সঙ্গে বৈঠকও সেরে ফেলেছিলেন তাঁরা। 

ববরা পরবর্তিকালে এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, আচমকাই রেস্তোরাঁ-র এক কর্মী এসে জানিয়ে যান যাতে কেউ নিচে না নামেন। কারণ, দুই দুষ্কৃতী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছে এবং তারা  হোটেলের নিচের লবিতে ঢুকে পড়েছে। কিছুক্ষণ পরেই এক কর্মী এসে জানান, তাজ হোটেলে জঙ্গি হামলা হয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে রুফটফ রেস্তোরাঁ-য় সশস্ত্র জঙ্গি দল আসতে পারে। রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের  নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কেউ যেন সেখান থেকে অন্য কোথাও না যায়, তা জানিয়ে দেওয়া হয়। 

বব এবং তাঁর সঙ্গীরা এই ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে ওয়াকিবহাল। তবে জঙ্গিদের মোকাবিলা করার মতো কোনও অস্ত্রই তাঁদের হাতে ছিল না। স্বভাবতই বব এবং তাঁর সঙ্গীরা ততক্ষণে বাঁচার রাস্তা খুঁজছিলেন। একটু দেরি হলেই রেস্তোরাঁ-য় থাকা বাকিরা যে প্যানিক অ্যাটাকে কাবু হতে পারে তা আন্দাজ করে নিয়েছিলেন বব। 

২০১৮ সালে মুম্বই মিরর-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বব জানিয়েছিলেন, রেস্তোরাঁর সবাই-কে তাঁরা প্রথমে একত্রিত করেন। সকলে যাতে অযথা চিৎকার না করেন এবং আতঙ্কগ্রস্ত না হন সে জন্য মোটিভেশনাল স্পিচ রাখেন বব। রেস্তোরাঁর শেফ-দের কাছ থেকে জোগাড় করা হয়েছিল তরকারি কাটার চাকু। বব-দের দ্বিতীয় প্ল্যানে ছিল ছাদে থাকা রেস্তোরাঁয় আসার রাস্তাগুলো বন্ধ করা। শুধুমাত্র ফায়ার এক্সিটের রাস্তা খুলে রেখে বাকি সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেন বব এবং তাঁর ৪ সঙ্গী। 

লিফটে করে যাতে কেউ ২৫ তলায় উঠে আসতে না পারে তার জন্য তা অকেজো করা হয়। এরপরের কাজ ছিল মার্কিন পরিচয়পত্র থাকা মানুষজনকে কিছু প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া। ২০০৮ সালে ২৬ নভেম্বর রাতে তাজ হোটেলের রুফটপ রেস্তোরাঁয় বেশকিছু আমেরিকান পরিবার ছিল। এদের মধ্যে আবার কয়েকজন একটা সময়ে মার্কিন মেরিনে কাজ করেছিলেন। ববরা এই প্রাক্তন মার্কিন মেরিনদের পরিচয়পত্র লুকিয়ে ফেলতে বলেন। কারণ, জঙ্গিদের কাছে মার্কিনিরা বড় শিকার। সেদিন ওই রেস্তোরাঁ-য় ভারতীয় নৌ-বাহিনী-তে কাজ করা এক  সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত অফিসারও ছিলেন। মার্কিন মেরিনদের দলটি এবং ভারতীয় নৌ-সেনার প্রাক্তন অফিসার-রাও ববদের হাতে হাত লাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ববরা জানিয়ে দেন, তারা বরং যতদ্রুত সম্ভব তাদের পরিবারকে নিয়ে ফায়ার এক্সিট দিয়ে নিচে যাক। 

ভারতে বিসিসিআই-এর সঙ্গে কাজ করার সুবাদে বব মুম্বই-এর বেশকিছু থানা, পুলিশ অফিসার এবং প্রশাসনের কিছু কর্ত-ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছিলেন। এই সব যোগাযোগের ফোননম্বরগুলো একটি খাতাতে লিখে রেখেছিলেন বব। একজন মহিলাকে সেই ফোননম্বরের খাতাটি দিয়ে সমানে ফোন করে যেতে বলেন। বব জানিয়েছেন, তাদের সেই মুহূর্তে ধারনাই ছিল না মুম্বইয়ের একাধিক জঙ্গি হামলা নিয়ে। ফলে, তাদের ফোন কেউ ধরছিলেন না। 

বব এবং তাঁর সঙ্গীরা এক ৯৫ বছরের মহিলা-কে চ্যাঙদোলা করে নিয়ে সিড়ি দিয়ে নামতে থাকেন। মোট ১৫০জনকে নিয়ে রেস্তোরাঁ-র রান্নাঘরের ভিতর দিয়ে ফায়ার এক্সিটে এসে পৌঁছেছিলেন ববরা। ফায়ার এক্সিটে আসার সময় তারা রান্নাঘরের সমস্ত রাকগুলো ফেলতে ফেলতে আসছিলেন যাতে একটা প্রাথমিক অবরোধ তৈরি হয়। 

প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ২৫ তলা থেকে ১ তলায় নেমে এসেছিলেন ববরা। সেইসঙ্গে ১৫০জনকে অক্ষত অবস্থায় তাঁরা নিচে নামিয়ে এসেছিলেন। বেসমেন্টে ববরা এসে দেখেতে পান চারিদিকে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। এরপর পুলিশবাহিনী তাদের উদ্ধার করে সুরক্ষিত স্থানে নিয়ে যায়। 

বব এবং তাঁর সঙ্গীরা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে বিসিসিআই-এর দপ্তরে আশ্রয় নেন। পরে সেখান থেকে তাঁদের উদ্ধার করে একটি ফ্ল্যাটে নিয়ে আসেন প্রফুল প্যাটেলের মেয়ে পুর্ণা। বব-দের নতুন করে পাসপোর্টও করাতে হয়েছিল। কারণ, পাসপোর্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস তারা তাজ হোটেলের ঘরেই ছেড়ে এসেছিলেন। এর দুই দিন পরেই দেশে ফিরে যান ববরা। 

মুম্বই মিরর-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বব জানান, ২০০৯ সালে-র ২৬/১১-তে তাঁরা ফের ফিরে আসেন মুম্বই-এ। হোটেলের একই রুম ভাড়া নেন। বুক করেন রুফটপ রেস্তোরাঁর তাঁদের পছন্দের জায়গাটা। যদিও, হোটেল কর্তৃপক্ষ-ই ববদের সমস্ত ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। যে ভাবে বব এবং তাঁর সঙ্গীরা ১৫০ জন মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তা গল্পকথায় পরিণত হয়েছে। বব-দের জন্য সেবার আরও বিষ্ময় অপেক্ষা করছিল। কারণ, হোটেলের লবি আসতেই দেখতে পান অসংখ্য মানুষকে। যারা সেই ১৫০ জনের মধ্যে ছিলেন অথবা তাদের আত্মীয়। সকলে এসে বব এবং তাঁর সঙ্গীদের ধন্যবাদ জানিয়ে যান। কারণ, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে বব ও তাঁর চার সঙ্গীকে তো কেউই কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে পারেননি। মুম্বই হামলার এক দশক পরেও এই স্মৃতি আজও ববদের চোখে জল এনে দেয়। সে দিন তাঁদের সঙ্গেও আরও ভয়ানক ঘটনা ঘটতে পারত বলেও মনে করেন তিনি।   

Share this article
click me!