অগাস্ট আন্দোলনে ঊষা মেহতার গোপন বেতার কেন্দ্র, কী বার্তা ছিল কংগ্রেসের

আগস্ট আন্দোলন যখন পুরোদমে চলছে তখন কংগ্রেসের সর্বক্ষণের এক মহিলা কর্মীর উদ্যোগে এদেশে তৈরি হল ‘সিক্রেট কংগ্রেস রেডিও’। ১৪ই আগস্ট সেই বেতার থেকে ভেসে এল সেই মহিলারই কন্ঠস্বর, ‘আমি ভারতের কোনও এক জায়গা থেকে ৪২.৩৪ মিটার বেতার তরঙ্গে চালিত ‘কংগ্রেস রেডিও’ থেকে বলছি...’

Tapan Malik | Published : Aug 9, 2020 1:13 PM IST

১৯৪২-এর ৯ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধী-সহ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নেতাদের গ্রেফতার করতে শুরু করলে প্রতিবাদে দেশজুড়ে আন্দোলন ভয়ংকর চেহাড়া নেয়। সেই আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফুর্ত, বহু জায়গায় আবার নেতৃত্বহীন। অন্যদিকে ব্রিটিশও তাকে দমন করতে নির্মম হয়ে ওঠে। পুলিশের গুলিতে প্রায় হাজার প্রতিবাদী প্রাণ হারায়। ভারত রক্ষা আইনে আটক হয় প্রায় ১৮ হাজার রাজনৈতিক কর্মী।       
আগস্ট আন্দোলন যখন পুরোদমে চলছে তখন কংগ্রেসের সর্বক্ষণের এক মহিলা কর্মীর উদ্যোগে এদেশে তৈরি হল ‘সিক্রেট কংগ্রেস রেডিও’। ১৪ই আগস্ট সেই বেতার থেকে ভেসে এল সেই মহিলারই কন্ঠস্বর, ‘আমি ভারতের কোনও এক জায়গা থেকে ৪২.৩৪ মিটার বেতার তরঙ্গে চালিত ‘কংগ্রেস রেডিও’ থেকে বলছি...’
এই ঘটনার ১৪ বছর আগে তাঁকে দেখা গিয়েছিল সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে সারা দেশে তখন আন্দোলন চলছে। সুরাট শহরে একদিন সকালে দেখা গেল বড়োদের একটি প্রতিবাদ মিছিল চলেছে। সেই মিছিলের শেষে একটি ছোট্ট মিছিল, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের হাতে তেরঙ্গা পতাকা,  কচি গলায় স্লোগান ‘সাইমন গো ব্যাক’। তাদের নেতা একটি আট কি নয় বছর বয়সী ছোট মেয়ে, চলেছে মিছিলে সবার আগে।
গোরা পল্টনেড় তাড়ায় পতাকা হাতে একটি মেয়ে পড়ে গেল রাস্তায়। মেয়েটি কিন্তু দমবার পাত্রী নয়। আবার মিছিল করল, এবার তেরঙ্গা কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করে, স্লোগান দিল, ‘পুলিশ  তুমি যতই করো, উঁচাও লাঠি, ব্যাটন ধরো, পারবে নাকো পতাকা মোদের কাড়তে’। 
সুরাতের খেরার প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী ঊষা মেহতা বড়োদের সঙ্গে মদের দোকানে পিকেটিং করতেও যেত। ছাত্রাবস্থাতেই সিদ্ধান্ত নেন তিনি আজীবন কংগ্রেসের কর্মী থাকবেন, সংসার করবেন না। ১২/১৩ বছরের মেয়েটি খাদির পোশাক পরতে শুরু করেন। লেখাপড়া শেষ করে ২২ বছর বয়স থেকে কংগ্রেসের সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিলেন। গান্ধীজির জীবনদর্শনই হয় তাঁর জীবনদর্শন। 
তাঁর সেই অসামরিক গোপন রেডিওর সাহায্যে গোপনে ইংরেজবিরোধী প্রচার চালানো, নেতা, সাধারণ কর্মী ও দেশের অন্যান্য প্রদেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ও নানা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ চলতে থাকল সন্তর্পণে। পুলিশের চোখে ধুলো দেবার জন্য প্রায় রোজই প্রচারকেন্দ্রের জায়গা বদল হত।
ওই বেতারের মাধ্যমে আন্দোলনের কাজ অনেকটা সহজ হল। ইংরেজ পুলিশের কাছে যেগুলি ছিল নিষিদ্ধ খবর সেগুলিই বিনা বাধায় জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছিল। বিপ্লবী আন্দোলন জোরদার  করা সহজ হয়েছিল, সারা দেশে আন্দোলনের আঁচ ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল অতি সহজেই।   
হাত গুটিয়ে বসে ছিল না পুলিশ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ সেই বেতার কেন্দ্রের সন্ধান পেল তিন মাস পর; ১২ই নভেম্বর। বেতারকেন্দ্রের প্রধান ঊষা মেহেতা-সহ সমস্ত সদস্যই গ্রেপ্তার হলেন। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা তাঁকে ছ’মাস ধরে জেরা করে। কিন্তু পুরো তিনি একটি কথা বলেননি। ছ’মাস জেলের একটি সেলে একা আটকা থেকেও তাঁর মনোবল ভাঙেনি। কংগ্রেসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে তাঁকে বিদেশে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেওয়া হবে এইরকম প্রলোভনও দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বাক। এমনকি বিচারের দিনগুলিতেও তিনি প্রশ্নের উত্তরে নির্বাক থেকেছেন। নিজেকে বাঁচাবার জন্যও তিনি কোন উত্তর  দেবার চেষ্টা করেননি । ফল হল চার বছরের জেল।পুণের ইয়ারাভেদা জেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল।
অন্তর্বর্তীকালীন ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোরারজী দেশাইয়ের নির্দেশে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে। তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তটি ছিল সিক্রেট কংগ্রেস রেডিওর কাজ শুরু করা আর সবচেয়ে তিক্ত আর দুঃখের মুহূর্তটি ছিল যখন জানলাম যে,একজন ভারতীয় টেকনিশিয়ানের বিশ্বাসঘাতকতায় এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের জায়গাটি্র সন্ধান  পেয়ে যায় ইংরেজ পুলিশ’। 


 

Share this article
click me!