পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই মুসলিম। সেখানে স্কুলছুটের সংখ্যা ২৭. ২ শতাংশ। স্কুলছুটের কারণ খুঁজলেন JNUর অধ্যাপক রুবিনা তাবাসুম।
শুধুমাত্র স্কুলছুট মেয়েদের কথাই আলোচনা করা হয়। কিন্তু ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ছেলেদের স্কুলছুটের হারও খুব একটা কম নয়। কারণ মেয়েদের মতই ছেলেদের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ খুবই কম। যার প্রভাব পড়ছে মুসলমান সমাজে। স্বাক্ষরতার পাশাপাশি শিক্ষগত অগ্রগতিতেও পিছিয়ে পড়ছে এই সম্প্রদায়। কিন্তু কেন এমন অবস্থা- তা নিয়েই আলোচনা করেন অনেকে।
ইন্সটিটিউট অব অবজেক্টিভ স্টাডিজের তুলনামূলক দৃষ্টিকোণে মুসলিম ড্রপআউটের অবস্থা- এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এই গবেষণাটি করেছেন রুবিনা তাবাসসুম,নতুন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তবে তিনি তাঁকে সাহায্য করার পুরো কৃতিত্বই দিয়েছেন ব্রিজেশকে। তাঁর গবেষণায় মুসলিমদের ড্রপআউট নিয়ে একাধিক অবাক করার মত তথ্য উঠে এসেছে। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছিল মুসলিমদের মধ্যে স্কুলে ভর্তির হার যেমন কমছে তেমনই বাড়ছে স্কুল ছুটের সংখ্যাও।
পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশই মুসলিম। সেখানে স্কুলছুটের সংখ্যা ২৭. ২ শতাংশ। এই রাজ্যে হিন্দুদের মধ্যে স্কুলছুলের সংখ্যাটাও খুব একটা কম নয়। হিন্দুদের মধ্যে স্কুল ছুটের হার ২২ শতাংশ। বিহারে মুসলিমদেক মধ্যে ড্রপআউটেরর হার ১৩.৯ শতাংশ।
প্রতিবেদনকে বলা হয়েছে মুসলমানদের আয় বাড়লেও তারা শিক্ষায় মনোযোগী হতে পারছে না। দুর্ভাগ্যবশত মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মৃত্যুর পর থেকে কোনও মুসলিম নেতা শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়ার বিষয়ে জোর দেয়নি। ইন্সটিটিউট অব অবজেক্টিভ স্টাডিজের প্রতিবেদনে তুলনামূলক দৃষ্টিকোন থেকে মুসলিম ড্রপআউটের অবস্থা একটি বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। রুবিনা তাবাসুম দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপরও প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন। রুবিনা তাবাসুমের মতে জাতীয় গড় ১৮.৯৬ শতাংশের মধ্যেই স্কুল ছুটের লক্ষণ দেখা যায়। সেথানে মুসলিমদের মধ্যে এই হার হল ২৩.১ শতাংশ।
রুবিনা বলেছেন বাংলা লক্ষদ্বীপ ও অসমের মত রাজ্যে স্কুলছুটের হার সবথেকে বেশি। মুসলমানদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি ঝোঁক কম থাকাই এর জন্য মূলত দায়ী। তিনি আরও বলেছেন, মানুষ শিক্ষাকে গুরুত্ব দিচ্ছে, কিন্তু যেভাবে দেওয়া উচিৎ সেভাবে দিচ্ছে না। তিনি আরও বলেছেন, শিক্ষার অধিকার আইন অনুযাযী অভিভাবকদের অবশ্যই তাদের ৬০১৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে। যাইহোক, মুসলিমরা প্রায়ই ১৫ বছর বয়সীদের স্কুল ছাড়িয়ে তাদের কাজ করতে পাঠায়।
মুসলিম সংখ্য়াগরিষ্ঠ জন্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা মোটেও ভাল নয়। কারণ এখানে প্রাক প্রাথমিকে স্কুল ছুটের হার ০.৭ শতাংশ। হিন্দুদের মধ্যে স্কুল ছুট দেখা যায় না। প্রাথমিকে হিন্দুদের মধ্যে স্কুলছুটের হার ৬.৫, মুসলিমদের মধ্যে ৫.৫ শতাংশ। মাধ্যমিক পর্যায়ে হিন্দুদের মধ্যে স্কুল ছুটের হার ৬ শতাংশ। মুসলিমদের মধ্যে ১২.৮ শতাংশ। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হিন্দুদের মধ্যে স্কুল ছুটের হার ১৭.৩ শতাংশ। সেখানে মুসলিমদের মধ্যে স্কুল ছুটের হাক ২৫.৮ শতাংশ। উচ্চ মাধ্যমিকে হিন্দুদের মধ্যে স্কুলছুটের হার ১৫ ও মুসলিমদের মধ্যে ১৫.৪ শতাংশ।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, আসামে মুসলমানরা জনসংখ্যার ৩৪.২২ শতাংশ। এখানেও মুসলমানদের ড্রপআউটের হার উদ্বেগজনক। প্রাক ও প্রাথমিক শ্রেণীতে হিন্দু ৬, মুসলিম ৫.৯ এবং খ্রিস্টান ২৮.৮, প্রাথমিকে হিন্দু ১৫.০, মুসলিম ১২.৫ এবং খ্রিস্টান ২৬.৪, মধ্য ও উচ্চ শ্রেণীতে হিন্দু ২৮.০, মুসলিম ২৬.০ এবং খ্রিস্টান ৩০.০, মাধ্যমিক শ্রেণিতে হিন্দু ২৫.৮, মুসলিম ৩০.২, খ্রিস্টান ৩২.০ উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে, হিন্দু ১৩.৯, মুসলিম ১৯.৬ এবং খ্রিস্টান ১৯.২। একইভাবে, পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে হিন্দু ১১.৫, মুসলিম ৯.৬।
ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক, গুজরাট, কেরল, তেলাঙ্গনা, দিল্লিতেও মুসলিমদের মধ্যে ড্রপআউটের হার মারাত্মক। মুসলিমদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতাই এই প্রবণতার জন্য দায়ী বলেও জানিয়েছেব রুবিনা তাবাসুম। সমীক্ষা অনুসারে ২৩.০ শতাংশ মুসলিম শিশু , ১৮.৭ শতাংশ হিন্দু শিশুর মধ্যে আর্থিক ফারাকও দেখিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ১২৩১-১৭০০ টাকা যাদের পারিবারিক আয় তাদের মধ্যেই পড়াশুনা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি। যাদের আয় বেশি তাদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেকটাই কম।
তাবাসুমের গবেষণায় যে তথ্য় রয়েছে তাতে দেখা গেছে বিয়ে বা বাল্যবিবাহের কারণে বিশেষত মেয়েদের পড়াশুনা মাঝপথেই জোর করে থামিয়ে দেওয়া হয়। রুবিনা জানিয়েছেন, যদি নরেন্দ্র মোদী সরকার মৌলানা আদাদ শিক্ষা ফেলোশিপ প্রত্যাহার করে ও কর্ণাটকের স্কুল কলেজের মধ্যে বোরখা পরা বা নেকাবের মত পোশাক পরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় তাহলে শিক্ষায় এই দেশের মুসলিমরা আরও পিছিয়ে পড়বে। অসমে মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ড্রপআউটের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
রুবিনা তাবাসুম বলেন, যদিও পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের হার ২৭ শতাংশের বেশি এই রাজ্যে ড্রপআউটের সংখ্যা সবথেকে বেশি। রুবিনা বলেছেন মুসলিমদের মধ্যে নেতৃত্বের অভাবও স্কুলছুটের জন্য দায়ী। তিনি আরও বলেছেন ভারতের মুসলমান নেতারা খুবই দুর্বল। তাঁরা শিক্ষানিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদের পর আর কেউই শিক্ষা নিয়ে তেমনভাবে কথা বলেননি। তাঁর কথায় এমন নেতা নেই যিনি সঠিক পথ দেখাবেন। শিক্ষার সঙ্গে সম্প্রদায়কে যুক্ত করতে পারবেন। নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবেন- এমন নেতা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে নেই বললেই চলে।
ভারতে ১৪.২৩ শতাংশ মুসলমান খুবই দরিদ্র। মুসলমানরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত উপার্জন করেছে, কিন্তু তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কম খরচ করছে। আমাদের দেখতে হবে কোথায় কোথায় পড়াশুনা বন্ধ করে দেওয়ার সমস্যা তৈরি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কী করে তা বন্ধ করা যায় তাও দেখতে হবে।
অন্যদিকে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উদ্দেশ্য রুবিনা বলেছেন দেশে তাদের জনসংখ্যা খুবই কম, তবে তাদের পুরো মনোযোগ শিক্ষার ওপর। এ কারণে এই সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত শিশু রয়েছে। মুসলমানদেরও শিক্ষায় মনোযোগ ও বিনিয়োগ করতে হবে।
তাবাসুমের কিছু প্রশ্নঃ
বাধা কোথা থেকে আসছে?
অন্যান্য সম্প্রদায়ের মেয়েদের তুলনায় মুসলিম মেয়েরা খুবই দুর্বল। মেয়েরা বেশি লেখাপড়া করলে বিবাহ হবে না। সমাজে ছেলেরা তেমন শিক্ষিত নয়। দ্বিতীয়ত, বাবা-মায়েরা যেহেতু বিয়ের বয়স নিয়ে চিন্তিত, তাই মেয়েদের শিক্ষা ও চাকরির জন্য বাইরে যেতে দেওয়া হয় না।
মুসলিম প্রতিষ্ঠানের কি করা উচিত?
মুসলিম শিশুদের ড্রপআউট বন্ধ করতে মুসলিম প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত মানুষকে সচেতন করা। স্বাধীনতার আগে এসসি ও এসটি শিক্ষায় মুসলমানদের তুলনায় অনেক নিচে ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর এই সম্প্রদায়গুলিকে শিক্ষার বিষয়ে সচেতন করা হয়েছিল এবং আজ মুসলমানরা তাদের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। যেসব মুসলিম সংগঠন এ নিয়ে কাজ করছে তাদের উচিত বিভিন্ন জায়গায় মানুষকে শিক্ষার বিষয়ে সচেতন করা। এর উপকারিতা বলুন। সমাজকে একটু বড় মনের পরিচয় দিতে হবে যে মেয়েরা বাইরে গিয়ে পড়ালেখা করে, রোজগার করে, তাহলে ভুল হয় না। যেখানে মাদ্রাসা আছে সেখানে আধুনিক শিক্ষাও চালু করতে হবে, ইউপিতে সবচেয়ে কম ঝরে পড়া, তার কারণ মাদ্রাসা, যেখানে মেয়েদেরও শিক্ষা দেওয়া হয়।