করোনার কোপে ত্রস্ত বিশ্ব। এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছে ৩৫ লক্ষ মানুষ। ১৮০টি দেশ জুড়ে ১৬.৮ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এরকম মহামারী আগে প্রত্যক্ষ করেনি পৃথিবী। রোগের ভয়াবহতা কাঁপন ধরিয়েছে স্বাস্থ্যকর্মীদের মনে। চিন প্রথম করোনা রোগের উপসর্গ সম্বলিত রোগীকে চিহ্নিত করে। তারপর থেকেই কার্যত সুনামির মতো আছড়ে পড়ে করোনা, আক্রান্ত হন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ।
কিন্তু করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে কাটাছেঁড়া চললেও, আজ পর্যন্ত সঠিক জবাব সামনে আসেনি। রয়ে গিয়েছে একাধিক প্রশ্ন। এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে করোনা-মহামারির কারণে বিধ্বস্ত বিশ্ব। কিন্তু কোথা থেকে এল এই মারাত্ম ছোঁয়াচে জীবাণু- যা দিনে দিনে শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছে- তাই নিয়ে প্রশ্নের অন্ত নেই। প্রথম থেকেই প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন চিনের উহান থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। এক বছর সেই একই দাবি করছেন তাঁর পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেয়। প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেয় বলেছেন চিনের উহান থেকেই যে জীবাণু ছড়িয়ে পড়েছিল তার প্রমান রয়েছে তাঁদের হাতে।
এই নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি চিন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে। দোষারোপ -পালটা দোষারোপের খেলায় সময় যত গড়িয়েছে, করোনা তত প্রকট আকার নিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। প্রথম তরঙ্গের পর এখন বিশ্ব জুড়ে চলছে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গকাল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি চিনের উহান ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির সাথে সার্স-কোভ -২ এর সংযোগের প্রমাণগুলি সরাসরি যুক্ত। তবে চিনের দাবি এই ল্যাব সবচেয়ে সুরক্ষিত শ্রেণীর অন্তর্গত, যা সাধারণতবায়ো সেফটি লেভেল ৪ বা বিএসএল ৪ হিসাবে পরিচিত।
উহানের ওয়েট মার্কেট, যেখানে জীবিত পশু ক্রয় বিক্রয় করা হয়, সেখান থেকে করোনা ভাইরাস প্রথম ছড়িয়ে পড়ে বলে দাবি করা হয়।
নামকরণ
কোভিড ১৯ ভাইরাসের নাম এর আগে একাধিক বার পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি SARS বা সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম নামে পরিচিত ছিল। পরে ফের নাম বদলে করা হয় সার্স ২০০২। এই ক্ষেত্রে পশুর থেকেই মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে আসে বাদুড়ের তত্ত্ব। তবে নতুন ভাইরাসটির জন্য, দেড় বছর পরেও এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এবং তবুও চিন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন ভাইরাসটিকে পুরানো সার্সের সাথে যুক্ত করে।
নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট জানায় প্রথমদিকে নতুন ভাইরাসটিকে উহান নিউমোনিয়া এবং উহান ভাইরাস নামে ডাকা হত। এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্রুত হস্তক্ষেপ করে, জানুয়ারী এবং ফেব্রুয়ারিতে এটির নামকরণ পরিবর্তন হয় তিনবার। এটিকে সার্স -২০০২ এর সাথে যুক্ত করা হয় এবং নতুন ভাইরাসকে সার্স -২ নামে অভিহিত করা হয়। পরে নামের সঙ্গে যুক্ত হয় করোনা ভাইরাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সেই নামও পরিবর্তন করে। জানানো হয় এর নাম হবে নভেল করোনা ভাইরাস।
করোনা ভাইরাসের উৎস নিয়ে একাধিক প্রশ্ন
কোথা থেকে উৎপত্তি হয়েছে করোনা ভাইরাসে। লাখ টাকার প্রশ্ন, শুধু উত্তর দিতে পারেননি কেউ। তবে যে তথ্যগুলি সামনে এসেছে, তা বেশ কয়েকটি প্রশ্নে উদ্রেক করে বৈকি। গত এক বছর ধরে এই বিষয়ে কাজ করছেন সাংবাদিক ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখক নিকোলাস ওয়েড। ওয়েড তুলে ধরেছেন এমন কিছু সত্যি, যা অস্বীকার করা যায় না। করোনা ভাইরাসের উৎস সম্পর্কে আমাদের ভাবতে বাধ্য করে।
এস গুরুমূর্তির লেখা থেকে ওয়েডের কিছু কাজের সন্ধান মেলে। নিকোলাস ওয়েড দেখিয়ে ছিলেন কীভাবে এই একটা ভাইরাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত সংগঠনকে তাবড় রাজনৈতিকদের হাতের পুতুলে পরিণত করেছিল। কীভাবে চিন ও আমেরিকার ঠান্ডা লড়াই বিশ্বের রাজনীতির মেরুকরণ ঘটিয়েছিল।
ওয়েড দুটো সহজ প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর লেখায়।
১. বাদুড়দের দ্বারা করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে তত্ব প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু জানা দরকার যে বাদুড় ৫০ কিমির বেশি উড়তে পারে না, তারা কীভাবে উহান থেকে ১৫০০ কিমি দূরে ইউনানে উড়ে গেল ভাইরাস চড়াতে।
২. যদি বা বাদুড়রা ভাইরাস ছড়াতে ইউনানে গেল, তার মাঝে পথের মধ্যে কেন কোনও এলাকায় ভাইরাস ছড়ালো না।
ব্যাট লেডির করোনা ভাইরাস
তাহলে কি মানুষের হাত রয়েছে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াতে? কি বলছেন ওয়েড? এখানে ওয়েড উল্লেখ করেছেন ব্যাট লেডির কথা। কে এই ব্যাট লেডি ? ওয়েডের লেখা থেকে জানা যায় ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে শি জেংগলি নামের এক মহিলা, যিনি ব্যাট লেডি নামেই পরিচিত, ১০০টিরও বেশি বাদুড়ের প্রজাতি সংগ্রহ করেছিলেন। নিয়ে এসেছিলেন উহানে।
তাঁর টিমে ছিলেন রালফ এস বারিক। তিনি নর্থ ক্যারোলিনার বিখ্যাত করোনা ভাইরাস গবেষক হিসেবেই পরিচিত।২০১৫ সালের নভেম্বরেই ল্যাবে তাঁরা দুজনে বানিয়ে ফেললেন করোনা ভাইরাস।
কীভাবে তৈরি হল করোনা ভাইরাস। ওয়েড বলছেন বিষয়টি খুব একটা জটিল নয়। তারা এটিকে সার্স -১ ভাইরাসের মেরুদণ্ড নিয়ে এবং এর স্পাইক প্রোটিনকে ব্যাট ভাইরাস থেকে প্রতিস্থাপন করেন, যা মানুষের শ্বাসনালীকে সংক্রামিত করতে সক্ষম হয়। ফলে করোনা ভাইরাস মানুষের হাতে তৈরি, বলছেন ওয়েড।
এবার হয়ত পাঠকের মনে পড়ছে সেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের গল্প। নিজের বিপদ কেন নিজেই ডেকে আনল মানুষ। আসলে বিজ্ঞানীরা চেয়েছিলেন যাতে ধীরে ধীরে এই ধরণের মারণ ভাইরাসের অ্যান্টিবডি মানুষের শরীরে তৈরি হয়ে যায়। যাতে ভবিষত্যে কোনও রকম ভাইরাস জনিত মহামারীর কবলে পড়তে না হয় বিশ্বকে। কিন্তু তার আগেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা। মহামারীর কবলে পড়ে গোটা বিশ্ব। । নিয়ে এসেছিলেন উহানে।