চিন-ভারত সীমান্ত সংঘাত নিয়ে মস্কোয় আড়াই ঘণ্টা ধরে প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকেও রফাসূত্র অধরা থেকে গেল। সংঘাতের মধ্যেই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হল। দু’পক্ষই লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর স্থিতাবস্থা জারি রাখার বিষয়ে সহমত হল। কিন্তু সমস্যার সমাধান অনেক দূরেই রয়ে গেল।
বৈঠকে লাদাখে অশান্তির দায় ভারতের ঘাড়েই চাপিয়েছে চীন। অন্যদিকে সীমান্তে স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে দিতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। কিন্তু তাতে বরফ গলে নি। বৈঠক শেষে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জানান, সীমান্তে স্থিতাবস্থা ফেরাতে দু’দেশকেই উদ্যোগ নিতে হবে। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা করা হবে। দ্রুত সীমান্তের পরিস্থিতি ও সেনাবাহিনীকে পূর্বের অবস্থানে ফেরানো প্রয়োজন। এসব কথা এ ধরণের বৈঠকে হয়েই থাকে।
চলতি বছরের মে মাসের গোড়ায় গালওয়ানে ভারত ও চীনা সেনার মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর এই প্রথম দু’দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে মুখোমুখি বৈঠক হল। এর আগে বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল চীনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই-র সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে ফোনে কথা বলেছিলেন। সেনাস্তরেও লাগাতার বৈঠক চলছে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না।
গত তিন মাস ধরে লাদাখ সীমান্ত কেন্দ্র করে ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে খুব তাড়াতাড়ি মিটমাটের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক রাজিনীতির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতের মধ্যে যা হচ্ছে তা দু’দেশের মধ্যে বৃহত্তর সঙ্কটের একটি উপসর্গ মাত্র। বিদেশ বা পররাষ্ট্র কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বৈঠক থেকে সেই বৃহত্তর সঙ্কটের সমাধান হবেনা। বড়জোর সংকট আয়ত্তে রাখার ক্ষেত্রে কিছু ভূমিকা হয়ত রাখতে পারে। তার বেশি কিছু প্রত্যাশা করা ঠিক হবেনা।
তারমানে ভারত ও চীনের মধ্যে বৃহত্তর সেই সঙ্কট আপাতদৃষ্টিতে যতটা সহজ বলে মনে হয়, তার ঠেকে ঢের গভীরে। দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বজায় রাখতে চীনের যে প্রচেষ্টা ভারত সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর চীন তাতে ক্ষুব্ধ। এ কথা ভারতও জানে লাদাখ সীমান্তে হঠাৎ করে তৈরি হওয়া এই সঙ্কট মূলত সেই ক্ষোভ থেকে।
প্রথমত; দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ভারত কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে; ভারত-বাংলাদেশ-মিয়ানমার ও চীনকে যুক্ত করতে রেল ও সড়ক নির্মাণের একটি প্রস্তাবেও ভারত বাগড়া দিয়েছে। এমনকি নেপালে ও বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারে চীনের জন্য বড় সমস্যা তৈরি করছে ভারত। যদিও ভারত সামরিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের তুলনায় পিছিয়ে কিন্তু ভারসাম্য বজায় রাখতে সে আমেরিকার নেতৃত্বে চীন বিরোধী যে জোট তাতে হাজির। তাহলে এই পরিস্থিতির সমাধান কি দু’দেশের মন্ত্রী কিংবা সামরিক কমান্ডারদের দু-চারটে বৈঠকে সম্ভব?
অন্যদিকে গত দুই মাসে ভারত এমন কিছু সামরিক-কৌশলগত পদক্ষেপ নিয়েছে যা নিয়ে চীন বেশ উদ্বিগ্ন এবং কিছুটা বিস্মিত। আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারত তাদের নৌবাহিনীর একটি আধুনিক রণতরী দক্ষিণ চীন সাগরে এমন এক জায়গায় (নাইন ড্যাশ লাইন) মোতায়েন করেছে যেটা চীন তাদের জলসীমার অংশ বলে দাবি করে। পাশাপাশি, আন্দামান-নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের কাছে ভারত যেভাবে নৌ শক্তি বাড়িয়েছে তাতেও চীন উদ্বিগ্ন।
ব্যবসার দিকে দিয়ে আন্দামান-নিকোবর মলাক্কা প্রণালীর পশ্চিম দিকের প্রবেশ পথ দিয়েই চীনের বাণিজ্যের ৬৫ শতাংশ চলে। চীনা মালবাহী জাহাজগুলোকে আন্দামান-নিকোবরের পাশ দিয়ে গিয়ে মলাক্কা প্রণালীতে ঢুকে ভারত মহাসাগরে পড়তে হয়। সেখানেই ভারত এমন ব্যবস্থা নিচ্ছে যাতে যে কোনো জাহাজকে তারা অবরোধ করতে পারে।
অন্যদিকে ভারতের সরকার প্রায় ১৮০টির বেশী চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে চীনা পণ্য এবং বিনিয়োগে ধস নামিয়েছ। এই পরিস্থিতিতে চীনের পক্ষে ভারতের সঙ্গে আপোষ-মীমাংসা করা খুব দুরূহ ব্যাপার। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি লাদাখ সঙ্কটের আপোষ মীমাংসায় বড়রকম নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোভিড প্যানডেমিক এবং অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে সরকার যে প্রবল চাপে রয়েছে তাতে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ হাবভাব ভারতবাসীর সামনে জাতীয়তাবাদী ধ্বজা তুলে ধরা একই সঙ্গে চলতি আর্থ-সামাজিক সঙ্কটকে ধামা চাপা দেওয়ার বিরাট বিকল্প।
অতএব সেনাপ্রধানদের আরও দু-চার গণ্ডা বৈঠক, বিদেশমন্ত্রী কিংবা সচিবদের আলাপচারিতা চলতেই থাকবে, মস্কোর পর দুনিয়ার আরও কোনও বড় শহরে চীন এবং ভারতীয় চার-প্যাচ মন্ত্রীর বৈঠক বসবে, কিন্তু তা পুজো শেষে শান্তির জল ছেটানো।