আপাতত চিকিৎসার জন্য রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে। তার আগে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী দলীয় নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন এনে যেভাবে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ঢেলে সাজিয়েছেন তাতে কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে রাহুল গান্ধীর প্রত্যাবর্তনের রাস্তা পরিস্কার। আর সেই পথ মসৃণ করতে ‘টিম রাহুল’-কে প্রাধান্য দেওয়ার বার্তা দিয়ে ছ’সদস্যের কমিটিতে আহমেদ প্যাটেল, এ কে অ্যান্টনি, অম্বিকা সোনির মতো সোনিয়ার পুরনো আস্থাভাজনদের জায়গা দেওয়ার পাশাপাশি রাহুলের দুই আস্থাভাজনক— কে সি বেণুগোপাল ও রণদীপ সিং সুরজেওয়ালাকে। নতুন সভাপতি নির্বাচন পর্যন্ত এই কমিটি সনিয়াকে সাহায্য করবে।
সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদকদের নতুন তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন গুলাম নবি আজাদ, মল্লিকার্জুন খড়গে ছাড়াও বাদ পড়েছেন কে সি বেণুগোপাল, মতিলাল ভোরা এবং অম্বিকা সনির মতো জ্যেষ্ঠ নেতারা।
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের আগে কংগ্রেস দলের সাংগঠনিক দুরবস্থা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে ২৩ জন ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতা সনিয়াকে চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠি সংবাদমাধ্যমেও ফাঁস হয়েছিল। দুদিন আগে দলের মিটিঙে হাই কম্যান্ড বিক্ষুব্ধ কগ্রেস নেতাদের বার্তা দিয়ে ২৩ জনের অন্যতম গুলাম নবি আজাদকে এআইসিসি-র ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। যদিও আজাদ হরিয়ানার দায়িত্বে ছিলেন তাঁকে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়নি।
বিক্ষুব্ধদের মধ্যে তরুণ নেতা জিতিন প্রসাদকে কংগ্রেসের কাছে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গ ও আন্দামান নিকোবরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এত দিন গৌরব গগৈ বাংলার দায়িত্বে ছিলেন। রাহুলের আস্থাভাজন গগৈকে আগেই লোকসভায় দলনেতা অধীর চৌধুরীকে সাহায্যের জন্য উপ-দলনেতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
রাজস্থানে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেও দলে থেকে যাওয়া সচিন পাইলটের আপাতত এআইসিসি-তে জায়গা মেলেনি। রাজস্থানে উপ-মুখ্যমন্ত্রী ও প্রদেশ সভাপতির পদ তিনি আগেই খুইয়েছিলেন। এইআইসিসি-তেও তাঁর কোনও দায়িত্ব মেলে নি।
শধু তাই নয়, আগামী দিনে সাংগঠনিক নির্বাচন ও সদস্য সংগ্রহ অভিযানের ইঙ্গিত দিয়ে মধুসূদন মিস্ত্রির নেতৃত্বে দলের নতুন কেন্দ্রীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষও গঠন করেছেন দলের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান সোনিয়া গান্ধী। বোঝাই যাচ্ছে দলের নেতৃত্বের সংকটসহ নানা ইস্যুতে সোনিয়াকে প্রবীণ নেতাদের চিঠি দেওয়ার পরই এই ব্যাপক রদবদল।
তার মানে রাহুল আবার ফিরছেন। আর সেই পথপ্রসস্ত করতেই রাহুলের ইচ্ছে অনুযায়ী সনিয়া কংগ্রেসের সংগঠন ঢেলে সাজালেন। ইন্দিরার মতোই রাহুলও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবির দায়িত্ব নেন। কিন্তু ফারাক হল, ইন্দিরা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাননি। রাহুল কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। ১৯৭৭-এর হারের দায়িত্ব নিয়ে ইন্দিরা বলেছিলেন, তিনি ১১ বছর ধরে পার্টির নেতৃত্বে। ব্যর্থতার দায় তাঁর। রাহুল ইন্দিরার মতো ১১ বছর যেমন পার্টির শীর্ষপদে ছিলেন না তেমনই তিনি মন থেকে ব্যর্থতার দায় পুরোপুরি নিজের ওপরও নেন নি। কারণ; ইস্তফার চিঠিতে রাহুল লিখেছিলেন, ‘বহু মানুষকে ২০১৯-এর হারের জন্য দায়ী করতে হবে। সভাপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব অবজ্ঞা করে অন্যদের দায়ী করা অনুচিত হবে’। তাঁর চিঠিতেই স্পষ্ট, পদত্যাগ করলেও তিনি আসলে একা হারের দায়িত্ব নিতে নারাজ ছিলেন।
অন্যদিকে সোনয়াকে চিঠি দেওয়ার কারণে যারা বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি-র তকমা পেয়েছেন তাঁরা যে আসলে দলের অধঃপতনের বস্তুনিষ্ঠ ময়নাতদন্ত চেয়েছেন, সেটা বুঝতে নারাজ সোনিয়া এবং রাহুল। তবে এ কথাও ঠিক ওই নেতারা কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুলের প্রত্যাবর্তন আটকাতে চাইছিলেন। তাঁদের মূল দাবি, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একা না লড়ে রাহুল সকলের সঙ্গে আলোচনা করে রণনীতি তৈরি করুন। লড়াইয়ের জন্য সংগঠন তৈরি করুন।
ওই নেতারা রাহুলের নেতৃত্বে হতাশ হচ্ছিলেন। তারা না বললেও বোঝাতে চেয়েছিলেন যে রাহুল নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে পেরে উঠবেন না। তাঁকে কংগ্রেসের গোটা নেতৃত্ব নিয়ে, বিজেপি-বিরোধী শিবিরকে সঙ্গে নিয়ে লড়তে হবে। কিন্তু রাহুল একা নিজেকে মোদী বিরোধী মুখ করতে তুলে ধরছিলেন। যে কারণে ভোটারদের চোখে তুল্যমূল্য বিচারে রাহুল সবসময় পিছিয়ে পড়ছিলেন।
দায়িত্ব না নিলেও গত এক বছর কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তার জন্য রাহুল যে অনেকাংশে দায়ী, তাতে সন্দেহ নেই। তিনি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। সেই ক্ষমতায় আবার ফিরতে চাইছেন বলেই তাঁর মাকে সেই ফিরে আসার পথ প্রসস্ত করতে হল।