আফ্রিকার সম্পদের দিকেও লোলুপ নজর বেজিংয়ের, ত্রাতার বেশে তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে চিন

  • আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে বিনিয়োগ করছে চিন
  • আফ্রিকার অর্থনীতির চেহারাই বদলে দিয়েছে বেজিং
  • দয়াপরবশ হয়ে এই বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ নয় চিনের
  • এর পেছনে তাদের বড় ধরণের স্বার্থ রয়েছে  বলে দাবি পশ্চিমের দেশগুলির

Asianet News Bangla | Published : Jun 26, 2020 9:36 AM IST / Updated: Jun 26 2020, 04:09 PM IST

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটেনের তৎকালীন  বিদেশ সচিব জ্যাক স্ট্র নাইজেরিয়া সফরে গিয়ে রাখঢাক না করেই মন্তব্য করেছিলেন, আফ্রিকায় চিন এখন যে কাজটি করে যাচ্ছে, ঠিক একই কাজ ব্রিটেন করেছিল ১৫০ বছর আগে। কাজটি কী, তা ভেঙ্গে বলার প্রয়োজন পড়ে না নিশ্চয়। স্ট্র'র মতো পাশ্চাত্যের অনেক রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিত বর্তমান সময়ে এই কথাটা  জোরগলায় বলছেন যে, চিন হল নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি। যে  শোষণ করছে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ। 

আরও পড়ুন: হংকংবাসীর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ চিনের, নয়া আইনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জিনপিংয়ের

দেখা গিয়েছে, দুনিয়ার যে প্রান্তেই অর্থসঙ্কট আর বিনিয়োগসঙ্কট দেখা দেয়,  সেখানেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার নিয়ে ত্রাতার বেশে হাজির হয় চিন। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা— সবখানেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে একালের অর্থনৈতিক পরাশক্তি শি জিনপিংয়ের দেশ। গোটা আফ্রিকা মহাদেশে চিন সূচনা করেছে এক ‘নতুন অর্থনৈতিক রেনেসাঁ’র। কিন্তু এর পেছনেও রয়েছে চিনের নিজস্ব স্বার্থ। 

 

ফরাসি পত্রিকা লা মঁদ কয়েক বছর আগে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনেই  উঠে এসেছিল চিনের ভালো মানুষির মুখোশের আড়ালে অন্য এক রূপ। আর তা হচ্ছে স্পর্শকাতর তথ্য চুরি বা হ্যাকংয়ের। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় একটি ঘটনা। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে আফ্রিকান ইউনিয়নের জন্য আলিশান এক সদর দফতরের উদ্বোধন হল। আফ্রকিরা সঙ্গে বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে সেই ভবনটি গড়ে দিয়েছিল চিন। কেবল সেই আধুনিক ভবনটি তৈরি করে দেওয়াই নয়, তার চেয়রা-টেবিল থেকে শুরু করে যাবতীয় আসবাব ও যন্ত্রপাতি সবই সেই সময় সরবরাহ করে বেজিং । সুবিশাল এই অট্টালিকাটির প্রায় ১০০ মিটার উঁচু টাওয়ারটি আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে চিনের নতুন মিতালির প্রতীক হয়ে সগর্বে নিজের অস্তিত্বের কথা যেন জানান দিচ্ছিল।  

ভবনটি উদ্বোধনের সময়  ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, নতুন এক আফ্রিকান রেনেসাঁ শুরুর প্রতীক এই ভবন। কিন্তু  কয়েক বছরের মধ্যেই সামনে উঠে আসে এক বিস্ফোরক তথ্য। জানা যায়, মূলত আফ্রিকান ইউনিয়ন ও এর সদস্য দেশগুলোর স্পর্শকাতর তথ্য চুরি করার জন্যই ভবনটি নিখরচায় তৈরিই করে দিয়েছে চিন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে  প্রতিরাতেই এই ভবন থেকে তথ্য হ্যাকিং করে পাঠানো হতো চিনের সাংহাইয়ের সার্ভারে। ভবনটি তৈরি করার সময় চিনারা হ্যাকিংয়ের জন্য নানা গোপন যন্ত্রপাতি পুরে দেয় এতে। ২০১৭ সালে এই নিয়ে শোরগোল তোলে বিদেশের একাধিক নামিদাবি সংবাদ মাধ্যম। 

বিষয়টি ধরা পড়ার পর এইউ নতুন সাইবার সিকিউরিটি সিস্টেম বসায়। তখন বেজিং বিনামূল্যে ব্যান্ড নিউ সার্ভার কনফিগার করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এইউ।   উল্টো তারা পুরো ভবনজুড়ে চালায় ব্যাপক তল্লাশি। আর তাতেই একে একে বের হতে থাকে থলের বেড়াল। দেয়ালে ও ডেস্কের নিচে পাওয়া যায় সুকৌশলে লুকানো মাইক্রোফোন। এমনকি চিনারা যে টেবিল-চেয়ার ও আসবাবপত্র সরবরাহ করেছে সেগুলোতেও লুকানো ছিল  আড়িপাতার যন্ত্র। চিন অবশ্য স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে নিজের দিকে ওঠা যাহতীয় অভিযোগ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেয়। সেই সময় ইথিওপিয়ায় নিযুক্ত চিনের রাষ্ট্রদূত দাবি করেছিলেন, ‘‘ আফ্রিকার নিজস্ব ব্যাপারে আমরা কখনো নাক গলাই না এবং আফ্রিকার স্বার্থরিরোধী কোনো কাজে কখনোই নিজেদের লিপ্ত করি না। ’’

এসবের পরেও অবশ্য আফ্রিকার উপর নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছে শি জিনপিংয়ের দেশ। আফ্রিকার বিভিন্ন  দেশের সঙ্গে নিজেদের টাকায় সুরম্য ভবন নির্মাণ করে দেবে বলে একাধিক চুক্তি করেছে চিন। তারা ইতিমধ্যে  জিম্বাবুয়ে ও কঙ্গোর প্রজাতন্ত্রের জন্য  পার্লামেন্ট ভবন বানাচ্ছে। পিরামিড আর নীল নদের দেশ মিশরের নতুন প্রশাসনিক রাজধানীর জন্য তারা গড়ে দিচ্ছে আস্ত একটা  বিজনেস ডিসট্রিক্ট। আর এসব সবটাই  করছে নিখরচায়। ইতিমধ্যে মালাওয়ি, সিচেলেস, গিনি বিসাউ এবং লেসোথোর মতো আফ্রিকার ছোট ছোট দেশগুলিতে নিজেদের প্রভাব ঘাটাতে শুরু করেছে বেজিং।  সিয়েরা লিওনে পার্লামেন্ট ভবন সংস্কার করে দিয়েছে চিন।   

 

পূর্ব আফ্রিকায় প্রতি চারটি বড় প্রকল্পের একটি এখন চিনের দখলে। আর আফ্রিকার সব ধরনের নির্মাণকাজের অর্ধেকই করে চিনারা। চিনের টাকাভরা লম্বা হাত এখন আফ্রিক মহাদেশের সবখানে। চিনকে এড়িয়ে যাবার সাধ্যি তাই এই গরিব দেশগুলোর নেই। তাই চিনের হ্যাকিং নামের ডেমোক্লিসের তরবারির নিচে মাথা পেতে দিয়েছে পৃথিবীর অন্ধকারতম মহাদেশের অসহায় মানুষগুলি। 

আরও পড়ুন: দক্ষিণ চিন সাগরেও কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে চিন, বেজিংয়ের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফুসছে ভিয়েতনামও

হ্যাকিং নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে পশ্চিমের দেশগুলো অভিযোগ তুললেও চিনাদের ওপর অবশ্য অতটা অখুশি নয় আফ্রিকার রাজনীতিবিদরা। এক কূটনীতিকের কথায়, চিন আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর ঔপনিবেশিকতার জোয়াল চাপায়নি, যা এককালে করেছিল ব্রিটিশ ও ফরাসিকা। বরং চিন আফ্রিকাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে! তাই জেনে শুনেই আর্থিক সাহায্যের নামে চিনের দেওয়া বিষ পান করে চলেছে পৃথিবীর অন্ধকারতম মহাদেশ। 


 

Share this article
click me!