ভিয়েতনাম এমন এক দেশ যারা একইসঙ্গে আমেরিকা ও ফরাসি উপনিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রক্তাক্ত লড়াইয়ের পর স্বাধীনতা অর্জন করেছিল৷ তার পরেই চিনা গণফৌজের হামলা রুখেছিল ভিয়েতনামের সেনাবাহিনী৷ চিন ভিয়েতনামের সীমান্ত যুদ্ধের সেই রেশ এখনও রয়ে গেছে দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে।
আমেরিকার সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষের পর স্বাধীনতা অর্জন করেছিল ভিয়েতনাম৷ আর স্বাধীনতার ঠিক পর ১৯৭৯ সালে ভিয়েতনাম ও চিন সীমান্ত যুদ্ধে প্রবল ধাক্কা খেয়েছিল চিনের গণফৌজ৷ এই যুদ্ধে মৃত্যু হয় বহু মানুষের৷ তারপর থেকেই বেজিং ও হ্যানয়ের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ভালো নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মাটিতে চিনা আধিপত্য ঠেকাতে নয়াদিল্লি হাত বাড়িয়েছে হ্যানয়ের দিকে৷ যদিও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রিপোর্ট বলছে, ১৯৭৯ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের জেরে বেজিংয়ের সঙ্গে হ্যানয়ের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা সময়ের সঙ্গে কমলেও এখন ভিয়েতনামের উপর চিনের দাদাগিরির স্বভাব যায়নি।
তবে দু’দেশের মধ্যে আর্থিক সম্পর্ক আগের থেকে উন্নত হয়েছে। তার মধ্যেই ভিয়েনামকে বারবার যুদ্ধের হুঙ্কার শুনিয়ে থাকে চিন। দক্ষিণ চিন সাগরে জলসীমা সংক্রান্ত বিবাদ নিয়ে চিন-ভিয়েতনাম টানাপড়েন দীর্ঘদিনের। ১৯৮৮ সালের যুদ্ধে ভিয়েতনামের হাত থেকে স্প্র্যাটলিস আর্কিপেলাগোর অনেকগুলি দ্বীপ ছিনিয়ে নেয় চিন। সে যুদ্ধে ভিয়েতনাম নৌসেনার প্রবল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এখন অবশ্য ভিয়েতনাম নৌসেনা আগেকার মতো দুর্বল নয়। ফলে স্প্র্যাটলিস দ্বীপপুঞ্জের যে সব এলাকায় এখনও চিন পা ফেলেনি সেগুলি সুরক্ষিত করতে চাইছে ভিয়েতনাম। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালও দক্ষিণ চিন সাগরে বেজিং-এর আগ্রাসনকে সম্পূর্ণ অবৈধ বলে ঘোষণা করার পর ভিয়েতনাম আরও আত্মবিশ্বাসী। বেশ কিছু দ্বীপে ভিয়েতনাম নৌসেনা যে পা ফেলবে, হ্যানয় সে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছিল।
চিন এখন সমুদ্রপথে বিভিন্ন দিকে বিস্তারলাভ করার চেষ্টা করছে। তাই দক্ষিণ চিন সাগরে চিনা আগ্রাসন ঠেকানোই এখন বড়ো চ্যালেঞ্জ ভিয়েতনামের কাছে। সেই কারণে এক সময় আমেরিকার সঙ্গি তিক্ত সম্পর্ক থাকলেও এখন যুক্তরাষ্ট্রকে পাশে নিয়ে তলতে কোনো সমস্যা নেই ভিয়েতনামের। যার ফলে দীর্ঘ ৪৩ বছর পরে ভিয়েতনামে নোঙর ফেলে মার্কিন রণতরী। বন্দর শহর ডানাং-এ ৬,০০০ কর্মীকে নিয়ে নোঙর ফেলে মার্কিন রণতরী কার্ল ভিনসন। সেই সময় ভিয়েতনামের বিদেশমন্ত্রক দাবি করেছিল, কার্ল ভিনসনের নোঙর ফেলার মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সহজ করা হচ্ছে।
দক্ষিণ চিন সাগরকে বরাবরই নিজের কব্জায় রাখতে চাইছে চিন। তাই দক্ষিণ চিন সাগরের অনেক দ্বীপকেই নিজের বলে দাবি করছে চিন। এর মধ্যে রয়েছে প্যারাসেল এবং স্পার্টলি দ্বীপও, যেগুলিকে নিজেদের বলে দাবি করে ভিয়েতনামও।
আরও পড়ুন: হংকংবাসীর স্বাধীনতাতেও হস্তক্ষেপ চিনের, নয়া আইনে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন জিনপিংয়ের
উল্লেখ্য, দক্ষিণ চিন সাগর বিশ্বের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ জলপথগুলির মধ্যে একটি। বিশ্বে, জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানির মোট পরিমাণের এক-তৃতীয়াংশই হয় এই পথে। তাই ওই অঞ্চলে অধিকার বিস্তার করতে দীর্ঘ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে চিন, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া।
গত বছরের শেষের দিকে চিনে করোনা সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। আর জানুয়ারির শেষের দিকে দক্ষিণ চিন সাগর নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে বিশ্ব রাজনীতিতে। ওই সময়ে চিন সরকারের কয়েকটি যুদ্ধজাহাজের যাতায়াত বাড়ে দক্ষিণ চিন সাগরে। আটক করা হয় বেশ কিছু মৎস্যজীবীকে। এই প্রসঙ্গে রাজনৈতিক আবহাওয়া গরম হয়ে উঠেছিল। ভিয়েতনাম দাবি করেছিল, চিনের যুদ্ধজাহাজের আক্রমণে তাদের ট্রলার ডুবি হয়েছে।
এরমধ্যে সম্প্রতি চিন দুটি গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছে কৃত্রিম কোরাল প্রাচীরের কাছে বলে জানা যাচ্ছে। আর এই গবেষণাকেন্দ্র দুটিতে রয়েছে সামরিক প্রতিরক্ষা। রয়েছে বিমান চলাচলের জন্য রানওয়েও। ফিলিপিন্স এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলিও জানিয়েছে সেই কথা। আমেরিকা এই অঞ্চলে চিনের জাহাজের আকস্মিক চলাচলকে ‘গুণ্ডামি’ বলেই কটাক্ষ করেছে। তবে স্বভাব সুলভ ভাবে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে বেজিং। চিনের দাবি, স্বাভাবিকভাবেই ওই জাহাজ সীমান্ত অঞ্চলে পর্যবেক্ষণ করছিল। এদিকে আমেরিকার পাশাপাশি ভিয়েতনামও আওয়াজ তুলেছে চিনের বিরুদ্ধে। বিতর্কিত অঞ্চলে পারসেল এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপে দুটি রাজ্য স্থাপন করেছে চিন। ভিয়েতনামের এই দাবিকে যদিও উড়িয়ে দিয়েছেন চিনের আধিকারিকরা। অন্যদিকে চিনকে সামরিক জাহাজ সরিয়ে নিতে বলা হলেও, চিন তা অস্বীকার করেছে। ফলে দক্ষিণ চিন সাগর ঘিরে বেশ কয়েকটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জট পাকাচ্ছে। এই মহামারীর মাঝে যা ত্বরান্বিত করতে পারে যুদ্ধ-পরিস্থিতিকে।