সাম্প্রতিক কালে নেপালের মানচিত্রি নিয়ে যে বিবাদ শুরু হয়ে তাতে পুরোপুরি ভাবে চিনের মদত রয়েছে ৷ চিন এবারও নেপালকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে৷ এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতির বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে দাবার ঘুঁটি করে চাল সাজাচ্ছে বেজিং প্রশাসন।
সম্প্রতি নিজেদের নতুন মানচিত্র প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছে নেপাল। যেখানে ভারতের লেইপুলেখ, কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা -কে নিজেদের অংশ হিসাবে দাবি করছে কাঠমান্ডু প্রশাসন। নেপালের ক্যাবিনেটও ইতিমধ্যে সেই মানচিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাম্প্রতি সময়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে বারবার ভারতী বিরোধী কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি চিনের করোনাভাইরাসের থেকেও বেশি ভয়ঙ্কর ভারত ভাইরাস, এমনটাই বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে ৷ নেপালের ৮৫ শতাংশ সংক্রমণের কারণ হিসেবে তিনি ভারত থেকে আসা লোকেদের দায়ী করেছেন ৷
এরআগে ভারতের অশোক স্তম্ভ ও অশোক চক্রকেও অপমান করেছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী ৷ তিনি ‘সত্যমেব জয়তে’কে বলেছিলেন সিংঘম জয়তে ৷ অশোক চক্রের সিংহকে ভারতের আসল মানসিকতার প্রকাশ বলে কটাক্ষ করেছিলেন ৷
২০১৫ সাল পর্যন্ত নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল ৷ ভারতে মোট ৮০ লক্ষ নেপালি থাকেন ৷ পাশাপাশি ভারতের গোর্খা রেজিমেন্টে ৩৫ হাজার সেনা কাজ করেন ৷ সীমান্ত নিয়েও দু পক্ষের মধ্যে কোনও সংঘাত ছিলনা ৷ পাশাপাশি নেপালের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্যিক সহযোগকারী দেশও ছিল ভারত৷ ৷ কিন্তু ২০১৫ সালে নেপালের সংবিধানে পরিবর্তনের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই ভারত বিরোধী হয়ে ওঠে৷ নেপালি কমিউনিস্ট দলের প্রধানমন্ত্রী ওলি ক্রমে চিনের ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন।
নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারত দীর্ঘকাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ভারতই একমাত্র বহির্শক্তি হিসেবে সক্রিয় থেকেছে। কিন্তু নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করার জন্য ভারত অগ্রণী ভূমিকা নেবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের সঙ্গে নেপালের দীর্ঘকালীন সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার প্রেক্ষিত তৈরি হয়। রাজতন্ত্রের মুলতুবি এবং ২০০৮ সালে তার অবসানের পর নেপাল নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে, নেপালের যাত্রা শুরু হয় ফেডারেলিজমের দিকে। যদিও এসব কোনও কিছু নিয়েই নেপালের সংসদে দীর্ঘ আলোচনা হয়নি। সেই সময় ইউরোপিয় ইউনিয়ন স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যতক্ষণ না ধর্মান্তরের অধিকার সংবিধানে না দেওয়া হচ্ছে, এই ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থহীন।
সেই সময় নেপালে ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের যৌথ হাজিরা এবং নেপালের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব দিকে লক্ষ্য রাখছিল চিন। ধীরে ধীরে নেপালে তাদের উপস্থিতি ও লগ্নি বাড়াতে শুরু করে চিন। তখন তাদের লক্ষ্য ছিল পর্যটন, ভূমিকম্প পরবর্তী পুনর্নির্মাণ, বাণিজ্য ও শক্তিতে। কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে বেজিংয়ের বার্তা ছিল নেপাল নিয়ে তাদের আগ্রহ ভারত ও তাদের মিত্রদের চেয়ে কিছু কম নয়।
একসময় জ্বালানিসহ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ভারতের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল নেপাল। এমনকি অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্যও নেপালকে ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে হত। তারপরেই ২০১৮ সালে নেপাল ও চিনের মধ্যে ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়। যারফলে এখন নেপাল চিনের তাইঝিন, শেনঝেন, লিয়ানয়ুগাং ও ঝানঝিয়াং বন্দর ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া চিন নেপালকে তাদের লানঝো, লাহাসা ও সিগতসে স্থলবন্দর ব্যবহারেরও অনুমতি দিয়েছে। সেই সময় বেজিং ও কাঠমান্ডুর মধ্যে এই সমঝোতা দিল্লির কপালে ভাঁজ ফেলছিল।
এরমধ্যে ২০১৯ সালে নেপাল সফরেও যান শি জিনপিং। সেই সময় কাঠমান্ডুতে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সঙ্গে জিনিপংয়ের বৈঠকও হয়। সেইসময় চিনকে সত্যিকারের বন্ধু বলে অভিহিত করেন ওলি। বাইরের পরিস্থিতির যে কোনো পরিবর্তন হোক-না-কেন, চিন ইস্যুতে নেপালের নীতি কখনও পরিবর্তন হবে না বলে আশ্বাসও দেন ওলি।
আরও পড়ুন: আফ্রিকার সম্পদের দিকেও লোলুপ নজর বেজিংয়ের, ত্রাতার বেশে তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে চিন
আর এই ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেই এবার কালাপানিকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করছে নেপাল। বর্তমানে ভারতের থেকে নেপালে চিনের বিনিয়োগ অনেক বেশি। তাই নেপালের প্রধানমন্ত্রীও ওখন ভারতে হুঁশিয়ারি দেওয়া শুরু করেছে। শোনা যাচ্ছে চিনের ইশারাতেই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় ১০০টি নয়া সেনা চৌকি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপাল। এখনও সীমান্তে ১২১ টি সেনা চৌকি রয়েছে। এবার সেই সংখ্যার সঙ্গে যোগ হবে আরও ১০০টি সেনা চৌকি। ফলে মোট ২২১ টি নেপালের সেনা চৌকি থাকবে সীমান্তে।
আরও পড়ুন: দক্ষিণ চিন সাগরেও কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে চিন, বেজিংয়ের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ফুসছে ভিয়েতনামও
এসএসবি ও ভারতের কেন্দ্রীয় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির খবর অনুসারে জানা গিয়েছে, নেপাল আর্মড পুলিশ ফোর্স-কে সীমান্তে নিয়োগ করা হয়েছে। খুব দ্রুততার সঙ্গেই সীমান্তে শুরু করা হবে আরও ১০০টি সেনা চৈকির কাজ। জানা যাচ্ছে, এই সেনা চৌকি ৫০০ পর্যন্ত বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছে নেপাল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এভাবে চিনের ঘনিষ্ঠ হয়ে অন্ধ ভারত বিরোধিতা করতে গিয়ে নেপাল নিজের বিপদ ডেকে আনছে নাতো। কারণ সম্প্রতি জানা গিয়েছে, নেপালের প্রায় ১১ টি জায়গায় মোট ৩৩ হেক্টর জমি দখল করেছে চিন। অর্থাৎ এবার নেপালকেও ধীরে ধীরে গ্রাস করার পরিকল্পনা করছে চিন। যদিও চিনের এই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এখনও চুপ প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি।
নেপালের কৃষি মন্ত্রকের করফে সম্প্রতি ১১টি স্থানের একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, এই জায়গাগুলিকে নেপালের প্রায় ৩৩ হেক্টর জমি নিজেদের দখলে নিয়েছে চিন। এমনকি সেখানে আউটপোস্টও বানানোর প্রক্রিয়াও শুরু করেছে লাল ফৌজ। কৃষি মন্ত্রকের সমীক্ষা দফতরেরে রিপোর্ট অনুযায়ী সম্ভাবনা আছে ওই অঞ্চলে সশস্ত্র পুলিশের বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট তৈরি করবে চিন। আর স্বাভাবিক সীমানা হিসাবে বয়ে চলা নদীর গতিপথও সেই কারণে বদলে দিয়েছে চিন।
৩৩ হেক্টরের মধ্যে ১০ হেক্টর জমি দখল করা হয়েছে হুমলা জেলায়, যেখানে চিনা নির্মাণের ফলে বাগদারে খোলা নদীর গতিপথ পাল্টে গিয়েছে। এছাড়া রাসুয়া জেলায় একাধিক নদীর গতিপথ পাল্টে দিয়ে চিন ৬ হেক্টর জমি দখল করেছে। সিন্ধুপালচক জেলার ১১ হেক্টর জমি খারানে খোলা ও ভোতেকোশি নদীর স্বাভাবিক সীমানা মেনে তিব্বতের মধ্যে পড়ছে দাবি করে দখল করেছে চিন।
এইসব রিপোর্ট সামনে এনে নেপালের কৃষিমন্ত্রক সরকারকে সতর্ক করেছে। চিনের আগ্রাসনের ফলে নেপালের আরও জমি চিনের মধ্যে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রকের তরফে রিপোর্টে বলা হয়েছে, নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েও সীমান্তে নেপালের জায়গা দখল করার চেষ্টা করছে পিপলস লিবারেশন আর্মি।
নেপালের সঙ্গে চিনের সীমান্ত আছে পূর্ব দিকে। সেখানে ৪৩টি পাহাড় পর্বত প্রাকৃতিক সীমান্ত হিসাবে কাজ করে। তা ছাড়াও আছে ছটি চেক পয়েন্ট বাণিজ্যের স্বার্থে। সেখানেই ১১টি নদীর পথ এখনও পর্যন্ত সরে গিয়েছে। এর ফলে ইতিমধ্যেই নেপালের চারটি জেলা জুড়ে থাকা ৩৩ হেক্টর জমি চলে গিয়েছে চিনের কাছে।
গত বছর প্রথম এই খবর প্রকাশ্যে আনে নেপাল সরকার। সেই নিয়ে নেপালের পথে বিক্ষোভও হয়। কিন্তু তারপর কৌশলগত ভাবে ভারত বিরোধী ইস্যুগুলিকে ইন্ধন দিতে থাকেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী। এর কারণ হচ্ছে চিনের সরকারের হস্তক্ষেপে নিজের গদি বাঁচিয়েছিলেন কেপি শর্মা ওলি।