খুন সম্পর্কে কোনও কূল কিনারা করতে পারছিলেন না তদন্তকারী অফিসাররা। পাওয়া যাচ্ছিল না খুনীর পরিচয়ও।
একটা খুন(Murder), একটা মৃতদেহ (DeadBody)। এপর্যন্ত সবই ছকে বাঁধা কিন্তু ঘটনার শুরু এরপর থেকেই। সাধারণত যেকোনও খুনের ক্ষেত্রে খুনীকে পাওয়া যায় না বা অমীমাংসিত থেকে যায় সেই মৃত্যু রহস্য। কিন্তু আজব কান্ড ঘটেছিল সেবার। শিকাগোয় ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (21s Feb, 1977) এক হত্যাকান্ড ঘটে। তেরেসিটা বাসা(Teresita Basa) নামে এক মহিলাকে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে রহস্যজনক ভাবে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
আদতে ফিলিপাইনের বাসিন্দা তেরেসিটা বাসা শিকাগো’র ২৭৪০ নর্থ পাইন গ্রোভ অ্যাভিনিউয়ে’র ১৫ বি নম্ব’র ফ্ল্যাটে’র বাসিন্দা ছিলেন। ইলিনয়ের রেসপিরেটরি থেরাপিস্ট ছিলেন তিনি। শিকাগোরই এডগেওয়াটার হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন তেরেসিটা। দমকলকর্মীরা একটা আগুন লাগার খবর পান অনেক ভোরে। সঙ্গে সঙ্গে বাসার অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ৪৭ বছর বয়সী তেরেসিতার মৃতদেহ আবিষ্কার করেন।
অ্যাপার্টমেন্ট রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী আগুনের খবর জানাতে জরুরি পরিষেবাগুলিকে কল করেন। যখন তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন একাধিক ছুরিকাঘাতের ক্ষত দেখা যায় বাসার শরীরে, সেই সঙ্গে আগুনে পুড়ে যাওয়া এক নগ্ন দেহ উদ্ধার করেন করেন দমকল কর্মীরা। বলাই বাহুল্য ওই দেহ বাসার ছিল। আপাত ভাবে মনে করা হয় বাসার ওপর যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। কিন্তু সেরকম কোনও প্রমাণ মেলেনি। যখন তেরেসিটাকে উদ্ধারকারী যখন উদ্ধার করা হয় তখন তাঁর দেহ কার্পেটে মোড়া ছিল ও দাউ দাউ করে জ্বলছিল। আগুন নেভানোর পর দেখা যায় তাঁর বুকেও একটি ছুরি আমূল বেঁধানো রয়েছে।
তদন্ত শুরু
খুন সম্পর্কে কোনও কূল কিনারা করতে পারছিলেন না তদন্তকারী অফিসাররা। পাওয়া যাচ্ছিল না খুনীর পরিচয়ও। বেশ ধন্দে পড়েছিল পুলিশ। খুনিকে খুঁজে পেতে এ সব তথ্য কোনও কাজে লাগেনি। একটি সূত্র অবশ্য তদন্তকারীদে’র হাতে এসেছিল। সেটি তেরেসিটারই হাতে লেখা একটি চিরকুট। যেখানে এ. এস নামে জনৈক ব্যক্তির জন্য থিয়েটারের টিকিট সংগ্রহ করার কথা লিখে রেখেছিলেন তিনি। তবে এই ‘এ.এস’-ই খুনি কি না? তা বোঝা যাচ্ছিল না, এই এ.এসের আসল পরিচয় কি তাও জানা যাচ্ছিল না।
অবশেষে তদন্তে নামেন প্রখ্যাত গোয়েন্দা স্ট্যানচুলা। তিনি তেরেসিটার শেষ ফোনের কথা জানতে পারেন। কাকে করা হয়েছিল শেষ ফোন। জানা যায় শেষ ফোন তেরেসিটা করেছিলেন রুথ লোবকে। রুথের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তাঁকে বাড়িতে এক পুরুষ অতিথি আসা’র কথাও জানিয়েছিলেন তেরেসিটা। তবে সেই অতিথির পরিচয় রুথ বলতে পারেননি।
৭টা ৪০ মিনিটে রুথের সঙ্গে কথা বলা শেষ করেন তেরেসিটা। আর সেদিনই সাড়ে ৮টায় তাঁর দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তাহলে এই ৫০ মিনিটে তেরেসিটার সঙ্গে কী হয়েছিল। তাহলে কি কোনও পুরুষ বন্ধুর হাতে খুন হতে হয়েছিল তাঁকে? কে সেই পুরুষ?
ওই বছর জুলাই মাসে নয়া মোড় মেলে মামলায়। হঠাৎই একটি নোট সব বদলে দেয়। নোটটি রাখা ছিল গোয়েন্দা স্ট্যানচুলার ডেস্কে। তাতে লেখা ছিল, তেরেসিটা খুনের অনুসন্ধান ক’রতে এই নম্বরে ফোন করুন। ফোন নম্বরটি ছিল ইভানস্টন পুলিশ দফতরের। সেখানে ফোন করে স্ট্যানচুলা জানতে পারেন তেরেসিটার হাসপাতালের এক সহকর্মী খুনী সম্পর্কে তথ্য দিতে পারবেন।
জানা যায় তেরেসিটার ওই সহকর্মী’র নাম রেমেবায়স বা রেমি চুয়া। তিনিও শ্বাসযন্ত্রের বিশেষজ্ঞ। তবে তার মুখ থেকে যা শোনা যায়, তা প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি দুঁদে পুলিশকর্তারা। স্ট্যানচুলা ভেবেছিলেন তাঁকে ডেকে গল্প বানিয়ে অপদস্থ করা হচ্ছে। কিন্তু এমন কিছু ঘটনা ও প্রমাণ হাতে পান তিনি, যার জোরে এই বিষয়টি এড়িয়েও যেতে পারেননি স্ট্যানচুলা।
রেমির স্বামী জানান, তাঁর স্ত্রী-র উপর না কি মাঝে মধ্যেই ভর করছে তেরেসিটার আত্মা। প্রথমে তিনি নানা জায়গায় তেরেসিটার মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন। পরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এরপর একদিন ঘুমের মধ্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম কণ্ঠস্বরে কথা বলে ওঠেন রেমি। রেমির স্বামী বলেন ওই গলায় রেমি নিজেকে তেরেসিটা বলে পরিচয় দেন। নিজের খুনের ঘটনার বর্ণনা দেন। বলে দেন খুনীর নাম। বলেন তাঁকে খুন করেছ অ্যালান সাওয়ারি নামে এক ব্যক্তি।
রেমির স্বামী প্রথমে বিষয়টি বিশ্বাস করতে চাননি। কিন্তু পরপর এরকম ঘটনা ঘটতে থাকে। এবার ওই কন্ঠস্বরের কাছে রেমির স্বামী প্রমাণ চান। এর জবাবে প্রমাণও দেয় ওই গলার স্বর। সে জানায়, অ্যালান সাওয়ারি ঘটনার দিন তেরেসিটার বাড়িতে টিভি মেকানিক হয়ে আসে। তেরেসিটাকে খুন করে দামী গয়না চুরি করে। যা পরে তার প্রেমিকাকে উপহার দেয়। ওই কন্ঠস্বর তেরেসিটার গয়নার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়।
ঘটনাটি বিশ্বাস না করলেও স্ট্যানচুলা ঠিক করেন, খতিয়ে দেখবেন বিষয়টি। অ্যালান নামের ওই ব্যক্তিকে ডেকে পাঠিয়ে জেরা শুরু করেন তিনি। একে একে মিলে যেতে থাকে অচেনা কণ্ঠস্বরের বলা তথ্য। মিথ্যে কথা বলে ধরা পড়ে যান অ্যালান। জানা যায়, ঘটনা’র দিন তিনি সত্যিই গিয়েছিলেন তেরেসিটার বাড়িতে। টিভি সারাতে সাহায্য করার নামে আসলে তেরেসিটার বাড়িতে ডাকাতি করারই অভিসন্ধি ছিল তাঁর। তেরেসিটার বাড়িতে ঢুকেই তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন অ্যালান।
অ্যালান খুনের অপরাধ স্বীকার করে। অদ্ভুত ভাবে তার প্রেমিকার কাছ থেকেও পাওয়া যায় তেরেসিটার চুরি যাওয়া গহনা। যা ওই অচেনা কণ্ঠস্বরের বলা কয়েকজন তেরেসিটার বলে চিহ্নিতও করে। কিন্তু সত্যিই কি তেরেসিটার আত্মা চিনিয়ে দিয়েছিল নিজের খুনিকে। গোয়েন্দা স্ট্যানচুলা এর জবাব দিতে পারেননি। প্রশ্ন করা হলে বলেছেন, ‘‘আমি এর কোনও ব্যাখ্যা পাইনি। তবে হয়তো ঘটনাটি আরও তলিয়ে দেখা যেত। হয়তো অন্য কোনও সত্যি প্রকাশ্যে আসত!’’