ইরান ও আমেরিকা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দুই দেশের অবস্থান দুই প্রান্তে। তাই আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সখ্যতা বৃদ্ধি একেবারেই না পসন্দ ছিল ইরানের। আর তার ফলশ্রুতিতেই চাবাহার রেলপ্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দিয়ে দেল তেহরান এমনটাই মনে করছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। আর এই গোটা ঘটনায় অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে চিন।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়দাড় হওয়া একেবারেই ভালভাবে নেয়নি ইরান। দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে একাধিক চুক্তি চক্ষুশূল ইরানের। পারমাণবিক চুক্তি থেকে একাধিক বিষয়ে বরাবরই আমেরিকার শত্রুপক্ষে রয়েছে ইরান। এরমধ্যেই চলতি বছরের শুরুতে ইরানের সেনাপ্রধান কাশেম সুলেমানিকে আকস্মিক ড্রোন হামলায় হত্যা করেছিল আমেরিকা। সেই প্রতিশোধের আগুন এখনও জ্বলছে ইরানে। তাই চিরশত্রু আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সখ্যতা মানতে পারছে না পশ্চিম এশিয়ার এই দেশ।
আরও পড়ুন: তেহরানকে এবার কাছে টানল বেজিং, চাবাহার রেল প্রকল্প থেকে ভারতকে সরিয়ে দিল ইরান
চলতি বছরের শুরুতে সুলেমানির আকস্মিক হত্যার পর ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি নিশানা করে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরে পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনা বহু গুণ বেড়ে গিয়েছিল। আর এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে ভারতকে পাশে পেতে প্রকাশ্যে বার্তা দিয়েছিল তেহরান। সেইসময় ভারত নিশ্চুপ থাকারই নীতি নিয়েছিল। কারণ আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে সংঘাত কোনা পথে মোকাবিলা করা হবে মোদী সরকারের বিদেশনীতির পক্ষে তা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
ইরানের সঙ্গে আমেরিকার উত্তেজনা বাড়তে থাকার সময় ওয়াশিংটন ভারতকে বারবার তেহরানের সঙ্গ পরিত্যাগ করার চাপ দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু অশোধিত তেলের কারণে ইরানের সঙ্গ পুরোপুরি পরিত্যাগ করাও ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ভারতের এই দোলাচল কিন্তু ইরানকে অনেকটাই দিল্লির থেকে দূরত্ব বাড়াতে রসদ যুগিয়েছিল। সেই কারণে চলতি বছের সিএএ বিয়ে দিল্লি হিংসার সময় পাকিস্তানের উস্কানিতে মুখ খুলতে দেখা গিয়েছিল একসময়ের বন্ধু ইরানকে। কার্যত সেই সময় ভারতের পরিস্থিতিকে একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি তেহরান। এদেশে সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল ইরান।
লাদাখ সীমান্ত সমস্যা নিয়ে চিন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির সময়ও বেজিংয়ের ঘনিষ্ঠ হতে দেখা গেল তেহরানকে। তাই চিনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তির পরই চাবাহার পর্যন্ত রেল প্রকল্প থেকে ভারতের নাম বাদ দিয়েছে ইরান। স্পষ্ট কোনও বিবৃতি না দিলেও চুক্তিতে ভারতের নাম নেই বলেই জানা গেছে। এই নিয়ে আপাতত কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের মতে, ইরানের এই সিদ্ধান্তের পিছনে চিনা উস্কানির আশঙ্কাই বেশি।
চিন এখন আমেরিকার ঘোষিত শত্রু। আর ওয়শিংটনের বিরোধিতাই চিন ও ইরানকে আরও কাছে নিয়ে এল তা বলাই বাহুল্য। বিশেষজ্ঞদের একাংশও বলছেন, চাবাহার প্রকল্প থেকে ভারতের বাদ পড়ার সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দু’টি। চিন আর আমেরিকা। তেহরানের সঙ্গে সম্প্রতি ২৫ বছর মেয়াদের ৪০ হাজার কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বেজিং। জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্রে মদত দেওয়ার অভিযোগে আমেরিকা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারির পর যা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল তেহরানের। অন্য দিকে, একই ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দিল্লির উপর বছর দু’য়েক ধরেই চাপ বাড়াচ্ছিল ওয়াশিংটন। যার পরিণতিতে ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে।
তবে এটাও ঠিক, ২০১৬-য় প্রধানমন্ত্রী মোদী তেহরান সফরে গিয়ে ইরান ও আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি করার পর রেলপ্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ভারতের তরফে ততটা আগ্রহ দেখা যায়নি, জানাচ্ছে ওয়াকিবহাল মহল। ভারতের তরফে কাজটা করার কথা ছিল ‘ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ কনস্ট্রাকশান লিমিটেড (আইআরসিওএন)’-এর। প্রকল্পে আইআরসিওএন-এর ১৬০ কোটি ডলার খরচ করার কথা ছিল। ভারতের উদ্বেগ ছিল, কাজটা শুরু করলে আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধেও জারি করতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। সেই কারণেই হয়তো চাবাহার রেলপ্রকল্প থেকে ভারতের নাম বাদ গেলেও বিদেশমন্ত্রক এ ব্যাপারে এখনও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে।