অমর পাল, পেশায় মোটর মেকানিক। পেটের টানে ছোটবেলাতেই পড়াশুনোর পাঠ চুকিয়ে বাইক সারাইয়ের কাজ শেখা শুরু করেন। ফলে, শখ আর স্বপ্নের হাতছানিতে সাড়া দেওয়া হয়নি। কারণ, সে সময় স্বপ্ন দেখার কোনও উপায় ছিল না তাঁর কাছে। তাই নিজের ভিতরে লুকিয়ে থাকা শিল্পীসত্ত্বাটাও চাপা পড়ে যায়, গ্যারেজের ধুলো-কালি-ময়লার নিচে, রুজি রোজগার আর টিকে থাকার লড়াইয়ের চাপে। যে স্বপ্নের দিকে ছেলেবেলায় সে ভাবে নজর দেওয়া হয়ে ওঠেনি, সেই স্বপ্নের টানেই যখন গ্যারেজের ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র দিয়ে তাঁর তৈরি করে ফেললেন দুর্গা প্রতিমা, তখন তা নজর কাড়ল সকলেরই। আজ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম এবং পত্র-পত্রিকার দৌলতে অমর পাল-কে চেনেন অনেকেই। বেলঘরিয়ার নন্দননগর এলাকার, আমতলার ছোট্ট গ্যারেজ পেরিয়ে এখন তাঁর কথা জানেন বরানগর, কামারহাটি এলাকার অগনিত মানুষ। সারা বছর যাঁর বাড়িতে বাইক সাড়াতে ভিড় করেন এলাকার লোকজন, পুজোর সময়ে তাঁর বাড়িতেই ভিড় করেন আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা অসংখ্য মানুষ।
শিল্পী অমর পালের তৈরি দুর্গা প্রতিমা দর্শনের দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ছুটে আসেন বেলঘরিয়া আমতলার মোড়ের ছোট্ট গ্যারেজে, পুজোর কটা দিন যা থিম পুজোর প্যান্ডেলের রূপ নেয়। কখনও ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, মোবিলের কন্টেনার, পুরনো ছেঁড়া কাগজ, ফাটা টায়ারের টুকরো দিয়েই বানিয়ে ফেলেন প্রতিমা। প্রতিমার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাজিয়ে তোলেন পুজো মণ্ডপও। দুর্গা পুজোর কদিন অমর পালের গ্যারেজ থিমের প্রতিমা আর মণ্ডপ সজ্জায় একেবারে অন্য চেহারা নেয়। এই গোটা ব্যপারটা একার হাতেই সামলান তিনি।
মেকানিক থেকে শিল্পী হয়ে ওঠা কবে থেকে, কী ভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে শিল্পী জানান, ২০০৯ সালে প্রথম ঝোঁকের বশেই গ্যারেজে পড়ে থাকা মোবিলের খালি কন্টেনার দিয়ে বিশ্বকর্মার মূর্তি বানিয়ে ফেলেন তিনি। পুজোও হয় তাতেই। সেই থেকেই শুরু। আমর পাল বলেন, "কারও অর্ডারে মূর্তি বানাই না আমি। ভাল লাগে, পারি তাই করি। তাই আমার তৈরি প্রতিমা আমি কাউকে দিই না।" প্রতি বছরের প্রতিমা পর পর রাখা রয়েছে অমর পালের গ্যারেজের একপাশে। এ বারে তাঁর প্রতিমা তৈরি হচ্ছে সিমেন্ট-বালি দিয়ে। তবে কোনও ছাঁচের সাহায্যে নয়। সিমেন্ট বালির মণ্ডতে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় একে একে প্রাণ পেয়েছে দুর্গা, সিংহ, অসুর-সহ বাকিরা। মণ্ডপ সেজে উঠছে গোপাল ভাঁড়ের নানা গল্পে।
মেকানিক থেকে শিল্পী হয়ে ওঠা অমর পালের তৈরি প্রতিমাগুলি যেমন অন্যদের তুলনায় একেবারে আলাদা, পুজোর ক্ষেত্রেও তেমনই একেবারে ভিন্ন রেওয়াজ। বিশ্বকর্মা পুজোর দিনই তাঁর তৈরি দূর্গা প্রতিমা সকলের দেখার জন্য সামনে আনেন তিনি। বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গেই সেরে ফেলা হয় দূর্গাপুজোও। তার পর কালী পুজোর আগে পর্যন্ত প্রতিমাগুলি সাজানো থাকে সকলের জন্য। এ প্রসঙ্গে শিল্পী বলেন, “আমি তো মেকানিক। তাই আমার পুজো বলতে ওই বিশ্বকর্মা পুজো। সে জন্যই একই দিনে দূর্গা প্রতিমার পুজোটাও সেরে ফেলি।” বেঁচে থাকার তাগিদে স্কুল ছেড়ে বাইক সারাইয়ের কাজ শিখে আজ এলাকায় মেকানিক হিসাবে বেশ নাম ডাক অমর পালের। তবে শুধু মেকানিক হিসাবে নয়, শিল্পী হিসেবেও লোকে চিনুক তাঁকে— এটাই স্বপ্ন অমর পালের।