উনিশ শতকের শেষ ভাগে লালন লিখেছিলেন, "বাড়ির পাশে আরশিনগর/ সেথা এক পড়শি বসত করে/ আমি একদিনও না দেখিলাম তারে৷"
লালন ক্রান্তদর্শী। দুই শতক পার করেও পড়শির সংস্কৃতিকে জানার অনীহাতেই তো খুন হয়ে যান আখলাখরা। পুড়িয়ে মারা হয় আফরাজুল খানকে। মেরুকরণের রাজনীতি সারা দেশ জুড়ে বটবৃক্ষের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
এই বিভেদের চেনা ছবির উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে প্রতিরোধের আর সাম্যের বার্তা দিতেই একজোট হলেন কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজন। হাওড়ার পিএম বস্তিতে এক অন্য মেজাজে পালিত হল ইফতার। রামনামের বুলি আর রহিমকে অনুকম্পার রাজনীতি পেরিয়ে, গত রবিবার ইফতার পালনের মধ্যে দিয়ে সাম্পদায়িকতা আর মৌলবাদের ব্যাপারীদের বার্তা দিলেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকরা।
ভারতবর্ষে লোকসভা ভোট শেষ হয়েছে গত ২৩ মে। ভোটপ্রচারের প্রথম দিন থেকে যে প্রবল হিংসার মুখোমুখি হয়েছে রাজ্য তা এক কথায় নজিরবিহীন। জায়গায় জায়গায় মাথাচাড়া দিয়েছে ধর্মীয় হানাহানি। এই অসহিষ্ণুতার আবহে ধর্মের বেড়া ভেঙে একে অন্যের সঙ্গে ফেজ টুপিটা বদলে নেওয়া, অথবা এক যোগে বসে হালিম খাওয়ার এই অনুষ্ঠান আকারে ছোট, কিন্তু ব্যাপ্তিতে বিরাট।
অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ লেখক সাদিক হোসেন। সাদিক হোসেন বললেন, "কোনও পতাকা নেই, নেই কোনও ধর্মের ট্যাগ। কেউ ফেজ পরছে কেউ পরছে না, সবাই মিলেমিশে আনন্দ করছে। এই ছবিটাই দেশে দেখতে চাই, কিন্তু পাই না। এই অনুষ্ঠান এবার প্রথম নয়। প্রতি বারই এখানে অনুষ্ঠানটা হয়, আমরা আসি। এবার আমার স্ত্রী ও মেয়েও এসেছে।"
কিন্তু পিএম বস্তিই কেন? লম্বা গল্প শোনালেন উদ্যোক্তাদের একজন, নাট্যকার জয়রাজ ভট্টাচার্য়। "কমিউনিস্ট পার্টি তৈরি হওয়ার সময়ে এখানকার জুটমিলগুলিতে বাম শ্রমিক ইউনিয়ন তৈরি হয়। মুসলমান অধ্যুষিত এই অঞ্চলটায় কখনও দাঙ্গা হয়নি। এমনকি '৪৬-এর দাঙ্গাতেও এখানকার লোকজন হিংসার খপ্পড়ে পড়েনি। দিন বদলেছে, এখানকার জুটমিলগুলি বন্ধ হয়ে হাইরাইজ তৈরি হয়েছে। সেই হাইরাইজে প্রধান উৎসব রামনবমী। আমরা সচেতন ভাবেই একটা সামাজিক বার্তা দিতে এই উৎসবে সামিল হয়েছি ধর্মের বেড়া ভেঙে, বেছে নিয়েছি এই বস্তিকে", অবিরল বলে চলেন জয়রাজ।
প্রায় ৭০০ লোকের খাওয়ারদাওয়া। সামাল দিতে হাত লাগিয়েছেন বাড়ির মা কাকিমারাই। বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়া মানুষগুলো হাসিমুখে সারাদিন ফল কাটছেন। পিএম বস্তির হাওড়া মজদুর জিমন্যাস্টিক ক্লাবের ছেলেরা ততক্ষণে হাত লাগিয়েছে চিকেন হালিম তৈরিতে। হালিম রান্না যে সে কথা নয়, মাংস আর নানা রকম ডালকে বশ মানাতেই লেগে যায় প্রায় ১২ ঘণ্টা। মাদাসস্সার নাজার, আশরাফ জাভেদ, কৌশিক হাফিজি, আসগরি সুলতানা, মালবিকা ঘোষ, শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য, উর্বী ভট্টাচার্যদের বেশ কয়েক দিনের মেহনত গরমের রোদ গলা বিকেলে সার্থক হল। পাশাপাশি বসে নিজেদের খাবার ভাগ করে নিল পিএম বস্তির ছোট্ট খুদে আর শহরের নামজাদা স্কুলে পড়া শিশু। সংসদীয় বামেরা এত বছর ক্ষমতায় থেকেও এই সহজ ছবিটা তৈরি করতে পারেনি। রাজ্যের অধুনা মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় ছুটেছেন ইমামের দরবারে।
আপাতত ইফতারে অংশ নেওয়া শিশুরা যে যার বাড়িতে খুব ব্যস্ত। গরমের ছুটিটাকে কাজে লাগিয়ে কেউ বন্ধুর জন্যে কার্ড তৈরি করছে, কেউ বা নিজের অভিজ্ঞতা লিখছে। আসলে লেখা হচ্ছে ইতিহাসের দলিল।
যেখানে শুরু করেছিলাম ফিরে যাই সেখানেই। উনিশ শতকের প্রবল ধর্মীয় হানাহানির আবহে লালন আসলে সমস্ত ধর্মকে নস্যাৎ করে সবার ওপরে জায়গা দিয়েছিলেন মানবধর্মকে। দুই শতক পার হয়েছে, ভারত দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। পিএম বস্তিতে জড়ো হওয়া মানুষগুলির হাতে সন্তানের হাত, চোখে অলীক স্বপ্ন। তাঁরা জানেন, একদিন পথ দেখাবেই পিএম বস্তি।