বসন্তের পোড়া রোদে বাসন্তি পুজোয় দুই পদার্থবিদ, মুখোমুখি দেবীপ্রসাদ ও সুস্মিতা

বিজ্ঞান হল যুক্তি-তর্কের গবেষণার এক ফল। কিন্তু, সমাজ জীবনের দর্শন বা ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদকে উহ্য করেই কি বিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কি হতে পারে? অথবা যদি বলা হয় বিজ্ঞানের উৎসের পিছনে কি, আর বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাটাই বা কিসের উপর ভিত্তি করে-দর্শন-পৃথিবীর সারবস্তু অথবা অন্যকিছু! যাই বলা হোক না কেন- বিজ্ঞান যে দর্শনকে উহ্য রেখে ব্যাখ্যা দিতে পারে বা জীবনরহস্যের কথা বলতে পারে তেমন প্রমাণ খুব একটা মেলেনি এখনও। অনেকে বলেন বিজ্ঞান সেটাই যা সভ্যতা ও বিশ্বের আধারের উপর একটি যুক্তি তর্কের ব্যাখ্যা তৈরি করে। 

debojyoti AN | Published : Apr 10, 2022 2:50 AM IST / Updated: Apr 10 2022, 08:30 AM IST

মহাকাশের তারার কারবারি তিনি। কয়েক দশক ধরে মহাকাশকে বাঙালির ঘরের দুয়ারে নামিয়ে এনেছেন। যার জেরে বাঙালি মহাকাশ নিয়ে চাক্ষুষ করেছে অনেক কিছু। সন্দেহ নেই মহাকাশের বিষয়-আশয়ে তাঁর সহজ সরল উক্তি এবং গল্প বলার তাগিদ বাঙালিকে আরও বেশি আগ্রহী করেছে অ্যাস্ট্রোনমিতে। যার জন্য তাঁর এই মহাকাশের গল্প শুনতে আজও সব বয়সের মানুষ নাম লেখান তাঁর স্পেশাল সব ক্লাসে। বলতে গেলে গত কয়েক দশকে বাঙালির একমাত্র জীবন্ত মহাকাশ কিংবদন্তি গবেষক ডক্টর দেবীপ্রসাদ দুয়ারি। 
কথায় আছে একজন সফল পুরুষের পিছনে নাকি হাত থাকে কোনও এক মহিলার।  ডক্টর দুয়ারি-র যারা ভক্তকুল রয়েছেন তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস এই মহিলাটি নিশ্চিতভাবেই সুস্মিতা দুয়ারি। যিনি ডক্টর দেবীপ্রসাদ দুয়ারির স্ত্রী কাম বন্ধু। কারণ বন্ধুত্বের বন্ধনে সেই ছেলেবেলায় বাঁধা পড়ার পরই চারহাত এক করে সংসারের পাকাপাকি বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন দু'জনাই। সুস্মিতার গুণও কম নয়। তিনিও একজন ফিজিসিস্ট এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় বহুদিন কাজ করেছেন। সতেন্দ্রনাথ বসুর ঈশ্বরকণা-র অস্তিত্ব নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন লন্ডনে নোবেল কমিটির অনুষ্ঠানেও।  

এহেন দুই মানুষ বেরিয়ে পড়েছিলেন বসন্তের এক ঘাম ঝরানো দিনে। বাজছে ঢাকের বোল, ঢং ঢং করে বেজে চলেছে মন্দিরের ঘণ্টা। টানা টানা চোখের মা বাসন্তীর অপরূপ দৃষ্টি। আর তাতে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয়েছেন ডক্টর দেবীপ্রসাদ দুয়ারি এবং সুস্মিতা দুয়ারি- দুই ফিজিসিস্ট স্বামী-স্ত্রী। যারা তাঁদের চেনেন, জানেন তাদের একটু বিস্মিত হতেই হবে। কারণ কলকাতা থেকে ৪০-৫০ কিলোমিটার দূরে মাকড়দহের এক গলি-পাড়ায়, এক্কেবারে মানুষের কোলাহল থেকে দূরে এমন দুই মানুষ- যাঁদের কাজ-কর্ম শিক্ষিত সমাজের কাছে এক প্রবল আগ্রহের। তবে, কেউ যদি ইতিমধ্যেই ভেবে বসে থাকেন যে বিজ্ঞানের মানুষ হয়ে মন্দিরে অঙ্গণে কেন? তাহলে তাঁদের বলতেই হয়- বিজ্ঞানের সাধক মানে যে তিনি মন্দিরে যেতে পারবেন না- এমনটা তো কোথাও লেখা নেই। বিজ্ঞানের তামাম ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে দুনিয়া জোড়া নাম কেনা বিজ্ঞানীদের কেউ যে ধর্মীয় আচার-রীতিকে মানতেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুঁজেও পাওয়া যায় না। অন্য কোথাও যেতে হবে না- বাঙালিদের মধ্যেই যদি চোখ ফেলা যায়- তাহলে বলতেই হবে, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা সংখ্যাতত্ববিদ মেঘনাদ সাহা-রা কেউ মন্দির বা পুজো-আচার্র ধার মাড়াতেন না! এমন কাহিনির প্রমাণ নেই। 

সামনা সামনি সাক্ষাৎ হতেই ডক্টর দুয়ারি-কে করতেই হল প্রশ্নটা। উত্তরটা নিজের কাছে জানা থাকলেও, ডক্টর দুয়ারি কী উত্তর দেন সেটার দিকেই বেশি করে ছিল নজর। সহজ-সরল ভাষায় বলেও দিলেন তিনি। সাফ জানালেন, ধর্ম মানে ধারণ করা। মানে নিজের মনুষত্ব্যকে অনুভব করা এবং অন্যের জন্য তাঁকে নিয়োজিত করা। ধর্ম মানে ভাবনা বা তত্ত্বের সঙ্কীর্ণতা নয়। ধর্ম হল একটা অনুভূতি। যা একজনকে সমাজের জন্য নিয়োজিত হওয়ার প্রেরণা জোগায়। একজন মানুষের এই অনুভূতি না থাকলে সে কীভাবে সমাজের কাজে আসবে! এমন প্রশ্নও পাল্টা ছুঁড়ে দিলেন দেবীপ্রসাদ দুয়ারি। মহাকাশ-তারা-সূর্য-গ্রহ থেকে অন্য সৌরজগৎ সব নিয়েই সমানে ভেবে চলেন তিনি। সেখান থেকে দাঁড়িয়েও তিনি মনে করেন মানুষের ধর্মাবেগ থাকা দরকার। তবে,উগ্র ধর্মীয় আবেগ কোনও কাজের নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। একজন ফিজিসিস্ট বলে যে তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ থাকবে না, এটা ঠিক নয়। তবে, ধর্মের আসল অর্থ-কে অনুসরণ করেই তিনি জীবনকে চালনা করতে চান। 

আর সুস্মিতা দুয়ারি! তিনি তো সাফ বলেই দিলেন মানুষকে স্বপ্ন দেখানো লোকের সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখলে তবেই তো মানুষ এগোবে। অধিকাংশের মনের মণিকোঠায় এখন কর্পোরেট চাকরির চমক চোখে মায়াবি জগত তৈরি করে। কজন আর জানতে চাইছে সভ্যতা এবং জগতের মূল শিকরগুলোকে। আগে যেভাবে মানুষ এই বিষয়গুলোকে নিয়ে সাধনা করতো এখন তো আর হচ্ছে না। সংখ্যাটা ক্রমশই কমছে। ধর্ম মানে মানুষের কাছে এখন আর নিরপেক্ষ থাকার আধার নয়। কিন্তু তার মাঝেও কিছু মানুষ রয়েছেন। তারা ধর্মকে ধারণ করেই জীবনকে কাটাতে চান। ধর্মের আবেগ হয়তো এদের কাছে খুব একটা জরুরি বিষয় নয়। 

আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু তো তাঁর বিজ্ঞানকে বৈদান্তিক সাহিত্যের দর্শনকে মাথায় রেখে সাজিয়েছিলেন। জীবনে প্রাণের সন্ধান নিয়ে তাঁর যে বিস্তৃত গবেষণা তার অনুপ্রেরণা যে ভারতের প্রাচীন ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে সম্পর্কৃত সে কথাও তুলে ধরেছিলেন ১৯০১ সালে লন্ডনের রয়্যাল ইনস্টিটিউশন অফ গ্রেট ব্রিটেনের মঞ্চে। যদি বর্তমান সময়ের ধর্ম-ধর্ম করে যারা রাজনৈতিক লড়াইকে এক সামাজিক লড়াইয়ে পরিণত করে দিয়েছেন তারা হয়তো জগদীশচন্দ্র বসু-র উদাহরণে খুশি হতেই পারেন। কিন্তু তাদের একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে ধর্মীয় আবেগ এবং ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদ দুটো এক জিনিস নয়। 

বিশ্ব বিজ্ঞান এবং পদার্থবিদ্যায় দুনিয়ায় বাঙালির আরও এক আবেগ সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তিনি তো পদার্থবিদ্যার সেরা খোঁজ-কে নামকরণ করেছিলেন গড পার্টিকল নামে। সোজা বাংলায় যার নাম ঈশ্বরকণা। কিন্তু, সত্যেন্দ্রনাথ ধর্মান্ধ ছিলেন এমন উদাহরণ পাওয়া যায় না। বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ধর্ম বরাবারই এই গাঙ্গেয়-দামোদর উপত্যকায় এবং হিমালয়ের তরাই অঞ্চল ও বারেন্দ্র ভূমিতে জীবনের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে এসেছে। ধর্মের দর্শন ও আধ্যাত্মবাদ একে অপরকে সম্মান জানিয়ে বাংলা এবং বাঙালিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এমন ইতিহাস সম্বলিত ভূমিতে ডক্টর দেবীপ্রসাদ দুয়ারি এবং ডক্টর সুস্মিতা দুয়ারি ভিন্ন পথের যাত্রী হবেন কি করে! তাই তাঁরাও তাঁদের পূর্বসূরীদের দেখানো পথেই ধর্মকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছেন। আর বলছেন স্বপ্ন দেখো বাঙালি। কারণ জীবনের ওটাই মূলমন্ত্র। এই স্বপ্ন ছিল বলেই আজকে মহাকাশের দুনিয়ার খোঁজে বাঙালির বড় ভরসার নাম দেবীপ্রসাদ দুয়ারি। তাই ধর্মের কারবারিরা ধর্মীয় আধ্যাত্মবাদ না ধর্মীয় আবেগকে নিয়ে বিতর্ক জিইয়ে রাখবেন- সেটা তারাই ঠিক করুন। যে সব মানুষ ধর্মকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে চাইছে- তাদেরকে সাধুবাদ।  
আরও পড়ুন|পৃথিবীর বাইরে মহাকাশে হতে পারে প্রাণের সঞ্চার, প্লুটোতে খোঁজ মিলল বরফের আগ্নেয়গিরির 
আরও পড়ুন| 'বছরে ৫০ হাজার মৃত মানুষ বেঁচে উঠবে' এমনই চ্যালেঞ্জ বিশ্বকে দিয়েছেন ডক্টর স্যাম পার্নিয়া 
আরও পড়ুন| মৃত্যুর স্বাদ কেমন? এমন মানুষের কিছু বয়ান যা উঠে এসেছে গবেষণায়

Share this article
click me!