কেন বারবার বিপন্ন হচ্ছে ফ্রিডম অফ প্রেসের ভাবনা, কী বলছে সাংবাদিককূল

  • ফ্রিডম অফ প্রেস কি সত্যি এখন আর সম্ভব নয়
  • এই ভাবনা কি আসলে একটা সোনার পাথরবাটি
  • কেন রক্ষা হচ্ছে না সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা
  • কী বলছেন সিনিয়র সাংবাদিক এবং সম্পাদকরা

Asianet News Bangla | Published : Nov 5, 2020 3:57 AM IST / Updated: Nov 05 2020, 10:12 AM IST

ফ্রিডম অফ প্রেস এই সময়ে দাঁড়িয়ে কতটা বাস্তব সম্মত একটা দর্শন? একজন সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম কেন ফ্রিডম অফ প্রেসের সুরক্ষা কবচ থেকে বারবার বঞ্চিত হচ্ছেন? কেন সঠিক তথ্য তুলে ধরলে বারবার হেনস্থার সম্মুখিন হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের? এর জন্য কারা দায়ী? রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলিয়ান রাজনৈতিক দল না সংবাদমাধ্যমের মালিক না এক শ্রেণির সাংবাদিক? আমরা কথা বলেছি কলকাতা শহরের বেশকিছু বিশিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে।  

সিদ্ধার্থ সরকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক
-------------------------------------------------------------- 
ফ্রিডম অফ প্রেস হল একটা ভুলভাল শব্দবন্ধ। যেখানে সংবাদমাধ্যমের মালিকপক্ষ বিজ্ঞাপণের অর্থ উপার্জনের জন্য সাংবাদিকতার মূল্যবোধের সমঝোতা করে নেন, সেখানে কেন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কথা হবে? কার স্বাধীনতা আপনরা চাইছেন?  

দেবদূত ঘোষঠাকুর, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক
--------------------------------------------------------------------  
আমরা সাংবাদিকরা অনেক কিছু জানতে পারি, কিন্তু নির্ভিকভাবে তা প্রকাশ্যে আনতে পারি কি? কারণ তা যদি কোনওভাবে প্রকাশ পায় তাহলে সেই সাংবাদিককের হেনস্থার সীমা থাকে না। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গের ছবি- এমনটা ভাবা ভুল, সারা দেশেই সাংবাদিকদের এই পরিস্থিতির মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। যার ফলে, অধিকাংশ সময়ে আসল ঘটনা, আসল তথ্য এড়িয়ে গিয়ে অন্যপথে খবর লিখতে হয় যাতে কেউ হেনস্থার মুখে না পড়ে। এটাই যদি একটা সাংবাদিকের অবস্থা হয়, তাহলে সাংবাদিকের স্বাধীনতা কোথায় থাকল! আমি নির্ভিকভাবে কোনও সত্য ঘটনা লিখতে পারবো না, তাহলে আর সাংবাদিকের স্বাধীনতা কোথায়। এটা যে কোনও সময়ে, যে কোনও পরিস্থিতি-তেই আমাদের দেশের যথার্থ নিদর্শন। যেখানে সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকেই মানা হয় না, সেখানে বারবার হেনস্থা হওয়াটা অবশ্যাম্ভাবি। আমরা এটাও জানি যে সত্য তথ্য লিখতে গেলে হয় মালিকপক্ষের বাধা পেতে হবে অথবা কোনওভাবে সেই প্রতিবেদন প্রকাশ পেলেও বিনিময়ে জুটবে হেনস্থা। এমনকী সাংবাদিকের পরিবারকেও ছেড়ে কথা বলবে না। এই অবস্থায় তখন ইনিয়ে-বিনিয়ে সত্য তথ্য যেটা একটা বিতর্ক তৈরি করতে পারে তাকে বাদ দিয়েই সংবাদ পরিবেশন করতে হয়। এহেন পরিস্থিতিতে তাই ফ্রিডম অফ প্রেস-এর কথা বলাটা অর্থহীন। 

রূপক সাহা, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক
---------------------------------------------------------  
ফ্রিডম অফ প্রেস নিয়ে আর কী বলব! এখন যা পরিস্থিতি হয়েছে তাতে ফ্রিডম অফ প্রেস-এর অতি সঙ্কটের  জন্য দায়ী এক শ্রেণির সাংবাদিক। সাংবাদিকতার নামে যে যা পারছে লিখে যাচ্ছে। যে সাংবাদিকের যাকে ভালো লাগে তাকে নিয়ে বড়াই করা হচ্ছে। এমনকী সাংবাদিকতার নামে সমানে মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছে। বলতে গেলে পক্ষপাতমূলক এই সাংবাদিকতার জন্য আজ আরও সঙ্কটে পড়েছে ফ্রিডম অফ প্রেস-এর ভাবনা। সারাজীবন নির্লজ্জ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধেই কাজ করেছি। চেষ্টা করেছি, সাংবাদিকতার আদর্শ মেনে সংবাদকে সকলের সামনে তুলে ধরতে। কিন্তু এখন তো এসব মানাই হয় না। সাংবাদিকের কলমে সারাক্ষণ স্থান পাচ্ছে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ। কোথাও কোনও সাংবাদিক অর্থের বিনিময়ে সংবাদ পরিবেশন করে চলেছে। কোথাও মালিকপক্ষ বাধ্য করছে সাংবাদিকদের আরও বেশি করে পক্ষপাতমূলক সাংবাদিকতার জন্য। এই যেখানে অবস্থা সেখানে ফ্রিডম অফ প্রেস বলে কিছু থাকবে কি? বলতে গেলে সংবাদমাধ্যমে সঙ্কটের জন্য সবচেয়ে বেশি করে দায়ী আমরা- এই সাংবাদিকদের দল। এটা শুধু বাংলা নয়- ভারতবর্ষের সমস্ত ভাষার সাংবাদিকতায় এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে। নিরপেক্ষ এবং তথ্যভিত্তিক খবর কোথায়- কোথাও তো দেখা যায় না। চারিদিকে সাংবাদিকতার নামে গল্প লেখা হচ্ছে। কোনও ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং এখন হয় না। এর জন্য তো মালিকপক্ষ-ই সবচেয়ে বেশি দায়ী। আসল সত্য প্রকাশে হয়তো বিপদে পড়ে যাবে তাদের পছন্দের কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা। তাই একশ্রেণির সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যের চালিকাশক্তিদের জন্য সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। 

সুমন চট্টোপাধ্যায়, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক
----------------------------------------------------------------- 
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে সরাসরি কোনও কথা হয়নি সুমন চট্টোপাধ্যায়ের। তবে, তিনি ফেসবুকের একটি পোস্টে লিখেছেন, যেভাবে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে এবং তাদের প্রতিনিয়ত হেনস্থা করার চল আরও বেশি মাত্রায় করা হচ্ছে, তাকে কোনওভাবেই সমর্থন করা যায় না। সুমন চট্টোাপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, তিনি অর্ণবকে বহুদিন ধরেই চেনেন। একটা সময় তাঁর জুনিয়র কলিগও ছিলেন অর্ণব গোষ্মামী। অর্ণবের বাবা-র সঙ্গেও তাঁর পরিচয় ছিল। কিন্তু, অর্ণব যেভাবে গত কয়েক বছরে সাংবাদিক হিসাবে খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছেন, সেই ধরনের সাংবাদিকতায় তিনি বিশ্বাস রাখেন না বলেই মত প্রকাশ করেছেন সুমন। সঙ্গে এটাও জানিয়েছেন, অর্ণবের সাংবাদিকতার ধরণ পছন্দ নয় বলে তাঁকে চরম ক্ষমতা দিয়ে বলপূর্বক হেনস্থা করা হবে এটাও মানা যায় না। এটা শুধু একজন সাংবাদিক নয় এটা সংবাদমাধ্যমের উপরেও তীব্র আঘাত। রাষ্ট্রশক্তি এভাবে যদি একজন সাংবাদিককে অমানবিক উপায়ে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে সেটা নিন্দাসূচক। 

 

অর্কপ্রভ সরকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদক
--------------------------------------------------------------- 
ফ্রিডম অফ প্রেস কথাটা শুনতে ভালো, কিন্তু রাজ্য কেন্দ্র কোথাও এর আক্ষরিক অর্থ সেভাবে মানা হয় না। কারণ, যেখানে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক তারা চান সংবাদমাধ্যম তাদের হয়ে কথা বলুক। তাই বিরুদ্ধ মত, বিরুদ্ধচারণ-কে তারা বিদ্রোহ বলেই মনে করে। সেই কারণে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বারেবারে হেনস্থা করার অভিযোগ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শাসনকালে বহুবার সামনে এসেছে। এটা কোনও ব্যতিক্রম ঘটনা নয়। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বিশেষ করে ভারতবর্ষে ফ্রিডম অফ প্রেস-এর ভাবনটাটা কার্যত সোনার পাথরবাটি। 

 

সুজিত চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক, আর প্লাস 
--------------------------------------------------------- 
ফ্রিডম অফ প্রেস-এর ভাবনাটা পুরোপুরি মানাই হয় না। আংশিক মানা হয়। বলতে গেলে পার্শিয়াল। দেখতে গেলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই সংবাদমাধ্যম একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে। সে সময় যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের শাসকগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন তাদের অনেকেই একটা সময় সাংবাদিকতা করেছিলেন। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে নানা খবর এবং বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন তুলে ধরেছিলেন। এমনকী, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে এমন আরও বহু নেতাই রয়েছেন যারা সাংবাদিকতা করেছেন এবং সম্পাদকের দায়িত্বও সামলিয়েছিলেন। ফলে এদের কাছেও ফ্রিডম অফ প্রেসের একটা মূল্য ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, সংবিধানেও ফ্রিডম অফ প্রেসকে সুরক্ষা কবচ দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সময় যত এগোচ্ছে ততই সংকুচিত হচ্ছে ফ্রিডম অফ প্রেসের ভাবনা। কোনও শাসকগোষ্ঠী মনপুঃত খবর করতে না পরলেই তাকে বিরোধী এবং বিদ্রোহী বলে গণ্য করা হচ্ছে। এর একটা বড় কারণ দেশের রাজনৈতিক আচার-আচরণ প্রবলভাবে দলতন্ত্রের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রসারতায় সঠিক অগ্রগতিও সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও আক্ষরিক অর্থে এই ভাবনাকে প্রসারিত করা হয়নি। এর ফলে রুদ্ধ হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। এর প্রভাব পড়ছে সংবাদমাধ্যমের উপরে। কারণ, তারাই সবচেয়ে বেশি করে যে কোনও আওয়াজকে জনগণের সামনে তুলে নিয়ে আসে। যার জেরে সংবাদমাধ্যমের টুটি চিপে ধরার একটা প্রবণতা বারবার ধরা পড়ছে। দুর্নীতি নিয়ে যারাই খবর করতে যাচ্ছে তাদেরকে হেনস্থা করা হচ্ছে। 

Share this article
click me!