৬ অগাস্ট, ১৯৪৫। দিনটা যেন ছিল মানব সভ্যতার উপরে সবচেয়ে বড় আঘাত। যেখানে কোনও দেশ নয়, একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সীমান্ত নয়, সবথেকে বড় হয়ে উঠেছিল মানবতার উপর অভিঘাত হানার বিষয়টা। বিশ্বজুড়ে শুধু ধিক্কার নয়, যদি মানবতার উপরে আক্রমণে সবচেয়ে বড় অপরাধী কেউ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে আমেরিকার নাম সর্বাগ্রে থাকবে।
অপূর্বকুমার ভট্টাচার্য, প্রাক্তন নাবিক--- জাহাজের নাবিক। ফলে জল হল ঘর আর ডাঙা হল অনেকটা বিবাহিত নারীর বাপের বাড়ির মতো। মাঝে মধ্যে আসা-যাওয়া। সাগরের জলের বিশাল বিশাল ঢেউ-এর আঁছাড় খাওয়া দেখতে দেখতে বেলা বয়ে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এত বড় সব ঢেউ-এর নিচের গভীরতাটা যেন এক রহস্য-রোমাঞ্চে মোড়া। মনে হয় যদি শরীরটাকে ঠেলে ওই ঢেউ-এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত! নাবিকের খেয়ালি মনে এমনই সব সাত সতেরো চিন্তা, কাজের বাইরে এক অন্য দুনিয়া খোঁজার চেষ্টা। এইভাবেই একদিন আমাদের জাহাজটা প্রশান্ত মহাসাগর থেকে গিয়ে ভিড়েছিল জাপানের বন্দরে।
সালটা ছিল ২০০৮। আমাদের জাহাজ সংস্থার যে বন্দর অফিস ছিল তা ছিল কুরে বলে একটি বন্দর শহরে। এখানে জাপানের সবচেয়ে বড় শিপইয়ার্ড। কুরে পৌঁছতে গেলে বুলেট ট্রেনে করে হিরোশিমা হয়ে সড়কপথে কুরে-তে পৌঁছতে হত। বুলেট ট্রেন যার গতি তখন বিশ্ব জুড়ে এক বিস্ময়। কি করে একটা ট্রেন এত দ্রুত গতিতে ছুটে যেতে পারে তাই সকলেরই জিজ্ঞাস্য। আর দশ-পাঁচটা বাঙালির মতো আমাকেও টানে বুলেট ট্রেন। নাবিক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন দেশে ঘোরার সুযোগ। তাই এবার জাপানে জাহাজ ভিড়তেই ইচ্ছে ছিল বুলেট ট্রেনে চেপে হিরোশিমা হয়ে কুরে যাব। চেপেও বসেছিলাম বুলেট ট্রেনে। টোকিও থেকে কুরে পৌঁছানোর পথে একটাই গন্তব্য সেটা হল হিরোশিমা।
৬ অগাস্ট, ১৯৪৫। দিনটা যেন ছিল মানব সভ্যতার উপরে সবচেয়ে বড় আঘাত। যেখানে কোনও দেশ নয়, একটা নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের সীমান্ত নয়, সবথেকে বড় হয়ে উঠেছিল মানবতার উপর অভিঘাত হানার বিষয়টা। বিশ্বজুড়ে শুধু ধিক্কার নয়, যদি মানবতার উপরে আক্রমণে সবচেয়ে বড় অপরাধী কেউ হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে আমেরিকার নাম সর্বাগ্রে থাকবে। তাই হিরোশিমা একটা পরমাণু বোমার শিকার হওয়া শিকার নয়, হিরোশিমা হল মানবতার এক পীঠস্থান, যে স্থানের দর্শন যে কেউ করতে চাইবে। তাই টোকিও থেকে কুরে যাওয়ার পথে হিরোশিমা দর্শন ছিল আমার কাছে অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়।
হিরোশিমার এই সফরনামার অভিজ্ঞতাটা ছিল এক প্রবল গর্বে ভরা। যে শহরকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়ার কথা নির্লজ্জভাবে দুনিয়ার সামনে বড়াই করেছিল আমেরিকা, সেই শহর এখন হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানবতার তীর্থক্ষেত্র। সেখানে নতুন নতুন প্রাণের স্পন্দন খেলে বেড়াচ্ছে। আর নতুন প্রাণের আবির্ভাবে অঙ্গিকার নেওয়া হচ্ছে বিশ্ব শান্তির। যে হিরোশিমা শহরে নাকি কোনও দিন সবুজের মেলা আর বসবে না বলে জাহির করেছিল আমেরিকা, সেখানে চারপাশ জুড়ে শুধুই সবুজের সমারোহ। যেন যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে সারিয়ে নিয়ে ফের প্রকৃতির জয়গানে জেগে উঠেছে হিরোশিমা। উচু-উচু ইমারত আর তাতে ঠুসে ঠুসে পুতে দেওয়া নানা রকমের গাছ।
হিরোশিমার মাটি-গাছ, লতা-পাতা, ঘাস সবকিছুই নাকি ৬ অগাস্ট, ১৯৪৫ থেকে বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল। কেউ বলতেন যেন ক্যানসারের বাহ্যিক চেহারাটা হিরোশিমার দিকে তাকালে দেখা যেত। সেই হিরোশিমাতে বিস্তীর্ণ জমি জুড়ে সবুজ ঘাস, চারপাশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের সারি। বাতাসের মৃদুমন্দর অনুভূতি মনকে আনচান করে দেয়। হিরোশিমার যে বাড়ি-কে লক্ষ্য করে পরমাণু বোমা লিটল বয়-কে যুদ্ধ বিমান থেকে নিক্ষেপ করেছিল আমেরিকা, সেই সব কিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। এখনও রয়েছে গেনবাকু ডোম। এই বাড়িটিকে হিরোশিমায় পরমাণু বোমার আঘাতের প্রতীকী চিহ্ন বা মেমোরিয়াল হিসাবে চিহ্নিত করেছে জাপান। এই বাড়ির চারপাশকে কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। এখনও নাকি এই বাড়ির গায়ে রয়েছে রেডও অ্যাক্টিভ। ফলে ওই বাড়ির ১০০ গজের মধ্যে যাওয়া এবং বাড়ির ভিতরে ঢোকা এখনও নিষিদ্ধ। একটা সময় ঠিক হয়েছিল যে ১৯৪৫-এর সমস্ত বাড়ি ভেঙে ফেলে দেওয়া হবে হিরোশিমায়। কিন্তু তা করা হয়নি।
হিরোশিমায় পরাণু বোমা নিক্ষেপের প্রতিবাদে তৈরি করা হয়েছে একটি বিশাল সৌধ। যে জায়গাটা দেখলে মনে হতে পারে একটা পার্ক। সেখান জল এবং গাছকে প্রতীকী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।
৬ অগাস্ট হিরোশিমায় এই মেমোরিয়ালের সামনে আজও জড় হয় মানুষ। দলে দলে নিয়ে আসে গোলাপের তোড়া। মেমোরিয়ালের উপরে রেখে দেওয়া হয় হিরোশিমায় পরমাণু বোমা নিক্ষেপে তেজস্ক্রিয়তার শিকার হওয়া সেই সব মানুষকে স্মরণ করে। এদিন পারতপক্ষে গোটা শহরটাতেই যেন বিরাজ করে শান্তির স্নিগ্ধতা। অধিকাংশ মানুষই যেন মৌনব্রত পালন করে। প্রিয় জনদের স্মরণ করে প্রত্যেকেরই চোখ ভিজে ওঠে।
হিরোশিমার উপরে পরমাণু বোমা লিটল বয় নিক্ষেপে সরকারিভাবে ২০ হাজার সেনার মৃত্যু হয়েছিল। মারা গিয়েছিলেন ১লক্ষ ২৬ হাজারেরও বেশি সাধারণ নাগরিক। অসংখ্য মানুষের কোনও খোঁজই পাওয়া যায়নি। যেন হাওয়ায় উবে গিয়েছিলেন এনারা। আর যেদিন লিটল বয়কে ফেলা হয়েছিল সেদিন বোমা নিক্ষেপের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো দেখতে বিশাল আকারের বিস্ফোরণের তীব্রতা তৈরি হয়েছিল। যা ছুয়ে ফেলেছিল আকাশটাকেও। এটা আজও মাশরুম ক্লাউড নামে পরিচিত। এই মাশরুম ক্লাইডের ব্যপ্তি এতটাই বিশাল ছিল যে কয়েক মাইলের মধ্যে থাকা সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ছড়িয়ে পড়েছিল তীব্র তেজস্বিকরণের বিষ। যার প্রভাব দশকের পর দশক বহন করেছে হিরোশিমা। বাড়ির দেওয়াল থেকে শুরু করে ট্রেন, বাড়ির আসবাবপত্র এমনকী মানুষ সকলেই দশকের পর দশক তেজস্বিকরণের এই বিষকে বহন করেছিলেন।
বর্তমান দুনিয়ায় সারাক্ষণ-ই একে অপরের বিরুদ্ধে হুমকি দিয়ে চলেছে রাষ্ট্রগুলি। প্রত্যেকেই চায় তাঁর ক্ষমতাকে প্রদর্শন করতে এবং মানব সভ্যতাকে পর্যদুস্ত করতে। কিন্তু, এতবড় একটা সভ্যতাকে কি নির্মূল করা সম্ভব? বিশেষ করে প্রকৃতি নিজে থেকে যতক্ষণ না চাইছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যতই ধ্বংসলিলা চলুক, মানব সভ্যতাকে শেষ করার চক্রান্ত হোক, তা সফল হবে না। কারণ প্রাণের স্পন্দন ফের দখল নেবে অশুভ-র বিরুদ্ধে। আর প্রকৃতি তাতে বারোআনাই সায় দেবে। হিরোশিমা সে কথা প্রমাণ করে দিয়েছে। তাই ৬ অগাস্ট হিরোশিমাকে সামনে রেখে কালোর অভিঘাত-কে তুড়ি মেরে জীবনের স্পন্দনে গান গওয়ার দিন।