রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। তবে এই ভোট পরবর্তী হিংসার বীজ হাইকোর্টে মামলার অনেক আগে শুরু হয়েছে একুশের রাজ্য-রাজনীতিতে।
রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে একাধিক মামলা দায়ের হয়েছে। তবে এই ভোট পরবর্তী হিংসা (Post Poll Violence) নামকরণে হাইকোর্টে মামলার অনেক আগে থেকে হিংসা শুরু হয়েছে একুশের রাজ্য-রাজনীতিতে। একুশের নির্বাচন শুরু হওয়ার আগে থেকেই এই হিংসার শিকার হয় একাধিক নেতা-নেত্রী-পরিবার ও তার অনুগামীরাও। রাজ্য়ের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস, প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরা প্রত্যেকই এই হিংসার শিকার হয়েছে। ভোটের পর ঘর ছাড়া বহু পরিবার। আর এই নিয়েই কাদা ছোড়াছুড়ি, সওয়াল-জবাবের পর মামলা উঠেছে হাইকোর্টে। রাজ্য়ের মাটি এসে ছুঁয়ে গিয়েছে জাতীয় মানবধিকার কমিশন। এবং তারপর হাইোকর্টের তরফে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-কে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইোকোর্ট (Calcutta High Court)।
রাজ্যে ২০২১ এর ভোট ছিল একটা বড়সড় ইস্যু। কারণ বামেদের শেষ দরবারে সিঙ্গুর আন্দোলন বা লালগড় ইস্যু না গেরুয়া শিবিরের কাছে না এলেও একুশের বিধানসভা ভোটকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তৃণমূলের অস্তিত্ব রক্ষা বা ভাগ্য নির্ধারণের ভোট হিসেবেই আখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু তীব্রভাবে 'পরিবর্তনের পরিবর্তন চাই' মাথা চাড়া না দিলেও চলতি বছরে যে পরিমাণ হিংসার ঘটনা ঘটেছে একুশের বিধানসভা ভোটের আগে এবং পরে, তা বলাই বাহুল্য একটা বড় ছাপ রেখে গিয়েছে। তাই বিপুল ভোটে জয়ী কিংবা ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর আগে হিংসায় একাকার হলেও হিংসার বীজ বপন হয়েছিল দিনহাটা- শালবনীর হাত ধরেই।
তখন ভোট শুরুর মাস। ভোটের ঠিক আগেই শালবনিতে উদ্ধার হয় বিজেপি কর্মীর ঝুলন্ত দেহ। মৃত ওই বিজেপি নেতার নাম লালমোহন সোরেন। স্থানীয় বিজেপি নেতা অভিযোগ তোলে, 'তৃণমূলই খুন করে ঝুলিয়ে দিয়েছে ওই কর্মীকে।' এদিকে এই ঘটনার পরে মেদিনীপুর বিধানসভার বিজেপি প্রার্থী , বিজেপির প্রাক্তন জেলা সভাপতি সমিত দাস কর্মীদের নিয়ে হাজির হয়ে যান তাঁর বাড়িতে ৷ ঘটনায় পরিকল্পিত খুনের অভিযোগ করে সমিত দাস বলেন,' পুলিশ সকালে দেহটি উদ্ধারের পরে পরিবারের লোককে পর্যন্ত জানায়নি ৷ আমাদের সক্রিয় কর্মী ছিল লালমোহন ৷ আদিবাসী যুবককে সফট টার্গেট করেছে তৃণমূল ৷ রাজ্যের সর্বত্রই একই কায়দাতে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় ৷ এই কাজ তৃণমূলের ৷ নির্বাচনের আগে সন্ত্রাশের বাতাবরন তৈরী করতে এই কাজ করেছে পরিকল্পিত ভাবে ৷ পুলিশ শাসকদলের হয়ে কাজ করছে ৷ আমরা প্রয়োজনের তদন্ত ও ব্যাবস্থা নেওয়ার আবেদন করছি ৷ ' প্রথম দফা নির্বাচনের ৩০ টি বিধানসভা আসনের মধ্য়ে শালবনি অন্যতম ছিল। ঘটনার পরই নির্বাচন কমিশনের তরফে জেলা পুলিশ সুপারকে বদলি করা হয়।
ভোট চলাকালীন চতুর্থ দফায় এসে সবচেয়ে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় কোচবিহারকাণ্ড। যেখানে সাতসকালেই ভোট দিতে এসে গুলিবর্ষণে প্রাণ হারায় একভোট। যদিও এই ইস্যু দুর্ঘটনা বশত হলেও বেলা পেরোতেই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিংসা শুরু হয়। ৮ দফা ভোট যত শেষের পথে এগিয়ে আসে, তত বেরিয়ে অত্যাচারে ছবি। মেদিনীপুর, হলদিয়া থেকে একের পর এক ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। একই পরিবারের ৫ জন পর্যন্তো ভোট পরবর্তী হিংসায় খুন হন। শুভেন্দু সহ যোগে ঘটনাস্থলে যান রাজ্যপাল। বাংলায় আসে জাতীয় মানবধিকার কমিশন। তাঁদের দেওয়া রিপোর্ট জমা পড়ে কলকাতা হাইকোর্টে। চাপ বাড়ে রাজ্যের। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিজেপি কর্মী খুন, ধর্ষণ, ঘরছাড়ার সংখ্যা বেশি হয়ে দাড়ায় কমিশনের রিপোর্টে। যদিও মানতে অস্বীকার করলেও, হাইকোর্টের নির্দেশে এরপর তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই।
ভোটের হিংসার নৃশংসভাবে শিকার হন বিজেপির কার্যকর্তা অভিজিৎ সরকার। লাইভ ভিডিওতে বাঁচার আর্জি জানিয়েও, শেষ অবধি তিনি বাঁচতে পারেন। বেধড়ক পিটিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এমনকি মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ ছা়ড়া পাওয়া নিয়েও কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি। এই ঘটনার সাক্ষি দিতে গিয়ে প্রাণ মেরে ফেলার হুমকি পান অভিজিৎের দাদা বিশ্বজিৎও। যিনি ছিলেন ভবানীপুর বিধানসভার বিজেপির তরফে অন্যতম প্রস্তাবিত নাম। যদিও মমতার বিপরীতে শেষ অবধি মহিলা প্রার্থীকেই দাঁড় করানো হয়। তবে ভোট পরবর্তী হিংসার মামলা এখনও চলছে। তড়িতবেগে তদন্তে কিনারা বার করছে সিবিআই।
ভোট পরবর্তী হিংসার ইস্যুতে মমতাকে একাধিকবার ট্য়াগ করে টুইটে তোপ দেগেছেন রাজ্যপাল। সেই লিস্টি থেকে তখন সদ্য আলাপনের স্থানে নিযুক্ত মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীও বাদ যাননি। তাঁকেও তলব করেছেন রাজ্যপাল জগদ্বীপ ধনখড়। রাজ্য পুলিশের ডিজিকে ট্য়াগ করে পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধেও বার্তা দিতে চেয়েছেন। রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। রাজ্যে ভোট পরবর্তী হিংসায় পুলিশ কার্যত কিছু করছে না বলেই অভিযোগ উঠে এসেছে। এবং তিনি নিজের বক্তব্যের সাপেক্ষে ভিডিও এবং অভিযোগপত্রও তুলে ধরেছেন। টুইটে রাজ্যপাল লিখেছেন, ভোট পরবর্তী হিংসা যেভাবে চলছে, তা মানবতাকে লজ্জা দেবে। পুলিশ কিছুই করছে না। ফলে সাহস বাড়ছে। পুরোটাই বিরোধীদের শাস্তি দিতে করা হচ্ছে।' যদিও রাজ্য়ের শাসকদল বরাবরই রাজ্যপালের টুইটের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। মূলত মমতার সরকারের ঢাল হয়েছে রাজ্যপালকে একাধিকবার নিশানা করেছেন কুনাল ঘোষ। তিনিও ক্ষোভ উগরে বলেছেন, 'রাজ্যপাল সাংবিধানিক পদমর্যাদকে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছেন। তিনি মানসিক অবসাদগ্রস্ত। ও একজন অতৃপ্ত আত্মা। নির্বাচনের আগে একজন রাজ্যপাল পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন। যেটা রাজ্যপাল পদ থেকে দেওয়া যায় না। বাংলার মানুষ এই ডাক প্রত্যাক্ষান করেছে। তাই অতৃপ্ত আত্মা, মানসিক অবসাদগ্রস্থ বৃদ্ধের এখন টুইট করাই কাজ।' যদিও ভোট পরবর্তী ইস্যু রাজ্য-রাজপালের এই সংঘাত কমে এলেও সেই ফাঁকা স্থান দখল করে নিয়ে নয়া বিতর্ক।