শহর কলকাতার ঝাঁ চকচকে তথাকথিত অভিজাত ফোরাম মলের বাকি সন্ধেগুলো কেমন কাটে, জানে কম বেশি সবাই। মলের মধ্যে আপাত সুখী মুখে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো ফোরামের আলোয় খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভোলে ফেলে আসা কাদা-মাটির পৃথিবীকে। সেই আলোর মধ্যে বসে স্বপন শেঠ বাজান ভায়োলিন।
সাকিন হারিয়েছে জীবনপুরের পথিক। আজ তার জীবন সায়াহ্নে একমাত্র সঙ্গী ভায়োলিন। শিল্পী সত্ত্বা উজাড় করে বাজিয়ে চলেছেন একের পর গান। সে ধুনে আদৌও কেউ মজছেন কিনা, দেখা বাহুল্য। তিনি স্বপন শেঠ। আধময়লা সাদা ফতুয়া পাজামায় আর পাঁচটা ছাপোষা বাঙালির মতই জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন হয়তো। তবে জীবন সাম্পান কি সবাইকে তীরে পৌঁছাবার সুযোগ দেয়? না হয়তো। তাই স্বপন শেঠের মত কেউ কেউ ব্যাথার নুড়ি পাথরগুলো ছড়িয়ে দেন শিল্পের মধ্যে। নাম দেন তার মণিমাণিক্য। ব্যথার মধ্যে থেকে জেগে ওঠে জীবন। ভুলিয়ে দেয় নুড়ি পাথর বয়ে চলার ভার।
শহর কলকাতার ঝাঁ চকচকে তথাকথিত অভিজাত ফোরাম মলের বাকি সন্ধেগুলো কেমন কাটে, জানে কম বেশি সবাই। মলের মধ্যে আপাত সুখী মুখে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো ফোরামের আলোয় খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভোলে ফেলে আসা কাদা-মাটির পৃথিবীকে। সেই আলোর মধ্যে বসে স্বপন শেঠ বাজান ভায়োলিন। একের পর এক গান, সুর, মূর্ছনায় ভরে ওঠে ফোরামের আলোময় সন্ধেগুলো। বিনিময়ে কি মেলে? রাতের ভাতে পেট ভরানোর অর্থ। পাশে রাখা বাক্সে নোট জমে, জমে খুচরোও। হয়তো সেই দিয়ে সেদিন রাতে ভাতের থালায় একটা তরকারি বেশি খেতে পান শিল্পী। তার বেশি চাওয়া আর জীবনের কাছে থাকে না কিছুই।
তবে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই স্বপন শেঠের ছবি উঠে এসেছে ফেসবুকের পাতায়। বিপ্লব আর্যের পেজে দেখা গেল তাঁকে, একমনে ভায়োলিন বাজাচ্ছেন। নেটিজেনরা সেই পোস্টে সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। এই বয়সে গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য হাতে ভায়োলিন তুলে নিতে হয়েছে তাঁকে, সে যেন বড়ই করুণ পরিণতি জীবনের।
তবে স্বপন শেঠের মত মানুষরা সংখ্যায় নেহাত কম নন। নানা চেহারার মধ্যেই লুকিয়ে থাকেন তারা। কোথাও ভায়োলিন শিল্পী হয়ে ফোরামে, কেউ কেউ আবার তুলির টানে পেট চালান নন্দনে, রবীন্দ্র সদনে। গড়িয়া হাটের ভিড়ে কেউ বই বেচেন, কেউ আবার শ্যামবাজারে দাঁড়িয়ে বিকিকিনি করেন হরেক মনোহারির। কিন্তু দিনের শেষে সবাই সমান তাঁরা। সন্তানরা দেখে না, আত্মীয়রা মুখ ঘুরিয়েছেন। তাই পোড়া পেটে ভাত দিতে হাতে তুলে নিয়েছেন জীবনযুদ্ধের অস্ত্র।
কাট টু ফোরাম মল। এক দিন নয়, দিন..প্রতিদিন স্বপন শেঠ বাজিয়ে চলেন ভায়োলিন। হয়তো বাড়িতে স্ত্রী বসে রয়েছেন ওষুধের আশায়। হয়তো কোনওদিন দুপুরে খাওয়া জোটেনি। তাই ফোরামের সেই সুখী মুখগুলোর কাছে একটু প্রত্যাশা দুটো টাকার। যদি আজকের দিনটা উতরে যায়, সেটাই অনেক। কালকের ভাবনা আবার বেজে উঠবে ভায়োলিনের সুরে। বুকে ছড়াবে নুড়ি পাথরগুলোর শব্দ। জীবন মুচকি হেসে ফোরামের সেই আলোয় মিশে যাবে....দিন চলবে ..চলতে থাকবে..