তপন মল্লিকঃ- শহর কলকাতায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা লেগেই আছে। আকারে ছোট হোক বা বড়; আগুন লাগাটা যেন রুটিন। বাগরি মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট, আমরি হাসপাতাল থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালের ক্যান্টিন পাশাপাশি বাজার ও বস্তিতে আগুন লাগেনি এরকম কোনও বছর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অগ্নিকান্ডে বিপুল সম্পত্তিহানি তো আছেই তারসঙ্গে মানুষের প্রাণের দাম; সে মূল্য তো অঙ্কে হিসাব দেওয়া মুশকিল। তবু বছরভর আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা লেগেই আছে এই শহরে। প্রতিটি আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত হয়, সরকারি চিঠি যায়, আর যা নিয়মকানুন আছে সবই হয়, হয় না কেবল কাজেরকাজ। তবে প্রায় প্রতিবারই একটা কথা শোনা যায়– প্রোমোটারির জন্য এই ঘটনা হয়েছে। তা না হলে বলা হয়, বাড়ির মালিক আর ভাড়াটিয়ার পুরনো ঝামেলা।
গত বুধবার দুপুরেই মানিকতলার একটি ব্যাটারি কারখানায় আগুন লাগে। আর সন্ধেবেলা বাগবাজার ব্রিজের কাছে একটি বস্তি ছাই হয়ে যায়। আগুন ছড়িয়ে যায় পাশের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের উদ্বোধন কার্যালয়ের একাংশে। শুধু আগুন নয়, একের পর এক সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হতে থাকলে এলাকায় তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাগবাজার বস্তির রেশ কাটতে না কাটতেই বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউটাউনের শুলুংগুরির ঝুপড়িতে আগুন লাগে। এখানেও আগুন পুড়ে ছাই হয়ে যায় বেশ কিছু ঝুপড়ি। বছরের শুরুতে কিংবা সদ্য পেরনো ২০২০ সালে কলকাতায় মোট যতগুলি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে দেখা যাবে বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটেছে শহরের বস্তিতে।
গত বছর ১৩ মার্চ আগুন লাগে ঢাকুরিয়া সংলগ্ন সেলিমপুরের একটি বস্তিতে। ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয় বেশ কয়েকটি ঝুপড়ি। আগুন ছড়িয়ে যায় সেলিমপুরের রেল ঝুপড়িতে। তদন্তে জানা যায় রান্না করার সময় অসাবধানবশত আগুন লাগে। বস্তিতে দাহ্য পদার্থ মজুত থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বেশ কিছু ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। একেই বস্তিগুলিতে গায়ে গায়ে লাগানো ঘর। এক চিলতে আলো-বাতাস ঢুকতে বেরতে পারে তেমন কোনও ফাঁক নেই। এমন ঘিঞ্জি পরিবেশেও রঙের কারখানা, ব্যাটারি কারখানা থেকে শুরু করে দাহ্য পদার্থ মজুত রাখার গুদাম- সবই আছে। আইনত থাকার কথা নয় কিন্তু কে মানছে। প্রশাসন সবই জানে। তাই প্রতি বছর নিয়ম করে আগুনে ভস্মীভূত বস্তির ছাই ঘেঁটে তদন্ত রিপোর্টে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি।
২০২০-র ২ জুন ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় কলকাতা লাগোয়া চিনার পার্কের আটঘরা বস্তি। স্থানীয়দের কথা অনুযায়ী রান্নার উনুন থেকেই আগুন লেগেছিল। আর তা থেকেই বাঁশ ও প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে কয়েক মুহুর্ত। এখানেও একের পর এক রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার ফাটতে শুরু করে। ওদিকে রাস্তা সরু হওয়াতে দমকলের ইঞ্জিন সেখানে ঢুকতে পারে না।
কলকাতার সব বস্তিগুলির রাস্তাঘাটের একই হাল। প্রত্যেকবার আগুন লাগে, সরু গলি দিয়ে দমকলের গাড়ি ঢুকতে না পারার জন্য প্রচুর হইচই হয় কিন্তু আগুন নিভে গেলে স্থানীয় মানুষ থেকে প্রশাসন কর্তাদের বেনিয়ম নিয়ে হইচই ছাই চাপা পড়ে যায়। গত বছর ভরা বর্ষার মাঝেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী হয় গঙ্গার পার লাগোয়া খিদিরপুরের বাবুবাজার বস্তি। এখানেও দমকলের ইঞ্জিন ঢোকাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়।
দমকল কর্মীদের বক্তব্য, মাকড়সার জালের মতো বিছিয়ে এবং ঝুলের মতো পাকিয়ে ঝুলে রয়েছে বিদ্যুতের তার, টেলিভিশনের কেবল। কার উৎস কোথায় বোঝা দায়, কোন তার কোথায় গিয়েছে তা বোধহয় বিশ্বকর্মা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবেন না। এরকম অবিন্যস্ত তার ও তারের জাল রয়েছে কলকাতার সর্বত্র। কোনও দিনও এই অবিন্যস্ত অবস্থা সুবিন্যস্ত হবে কিনা তাও কেউ জানে না।
করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ৭ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে নারকেলডাঙার ক্যানাল ইস্টরোড লাগোয়া ছাগলপট্টি বস্তিতে। ভস্মীভূত হয়ে যায় প্রায় ১০০টি ঝুপড়ি। লকডাউনের জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের অনেকেই চাল মজুত করে রেখেছিলেন, সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এরকম বস্তির সংখ্যা কলকাতায় কম নয়। এই সব বস্তিতে আগুন না লাগা পর্যন্ত কারও মনে হয় না যে এটা বস্তি না জতুগৃহ। শহর কলকাতার আগুন নিত্যকার বিষয় তাই প্রশাসন খুব একটা মাথা ঘামায় না। তাছাড়া সাধারণ মানুষও আজকাল চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে না ফলে প্রশাসনেরও সম্বিৎ ফেরে না।
গত ১৫ নভেম্বর দীপাবলির রাতে চারিদিক যখন আলোয় ভরে উঠেছে, সেই সন্ধিক্ষণে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে নিউটাউনের হাতিয়ারা বস্তিতে। নিউটাউনের নিবেদিতা পল্লীর অধিকাংশ ঝুপড়ি গুলি কাঠ ও বেড়া দিয়ে দিয়ে তৈরি হওয়ায় দ্রুত ছাই হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে দমকলের গাড়ি সময়মতো পৌঁছলেও এলাকার রাস্তা সরু হওয়ায় দূর থেকেই পাইপে করে জল দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করা হয়।
বছর শেষে গত ২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ইএম বাইপাসের ধারে পূর্বাশা আবাসন লাগোয়া বস্তিতে আচমকা আগুন লাগলে ছাই হয়ে যায় বেশ কয়েকটি ঝুপড়ি। লাগোয়া আবাসনেও তা ছড়িয়ে পড়ে। কাঠ-প্ল্যাস্টিক-বাঁশের ঘর, রং-ব্যাটারির অবৈধ কারখানা, দাহ্য পদার্থের গুদাম, আলো বাতাসহীন সরু গলি- এর নাম বস্তি। সেখানে প্রতিবছর নিয়ম করে আগুন লাগাটা এখন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে সাধারণ মানুষের যেমন তেমন প্রশাসনেরও। তাই সারা বছরই বাগবাজার, তপসিয়া, নারকেলডাঙা, হাতিয়ারা প্রভৃতি এলাকার নানা বস্তিতে আগুন লেগেই চলে।