বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় একজন সফল উদ্যোগপতি ছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বাঙালি যিনি ডক্টর অফ সায়েন্স উপাধি পেয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনও দিন বেতন নেননি তিনি। সফল উদ্যোগপতি হিসেবে আজও তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করে বাঙালি।
প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের শিক্ষক হিসাবে নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নিজের আত্মরচিতে বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্সি কলেজে আমার ২৭ বছর অধ্যাপনা জীবনে আমি সচেতনভাবে প্রধানত: নিচের ক্লাসেই পড়াতাম। কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পচ্ছন্দমত আকার দিতে পারে হাই স্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দরভাবে গড়ে তোলা যায়। আমি কখনও কোন নির্বাচিত পাঠ্যবই অনুসরণ করে পাঠদান দিতাম না’। নীলরতন ধর, রসিকলাল দত্ত, পঞ্চানন নিয়োগী, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ নামজাদা বাঙালি বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র। তাঁর এমাইন নাইট্রেট আবিষ্কারে সহায়ক ছিলেন শ্রীযুক্ত রক্ষিত। যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। যে ছাত্রটি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তিনি ‘সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ভারতীয় উপমহাদেশের অবস্থা’ শীর্ষক রাজনীতির গবেষণামূলক বই লিখছেন। ওই ছাত্রটি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বাঙালি হসাবে ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ উপাধি অর্জন করেন।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার শুরুতে তাঁর প্রথম গবেষণার ফল বের হয় জার্নাল অফ এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গলে। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়ায় জায়গা নেয় সেই নাইট্রেট, ‘ বিসম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙালি দিয়েছে বিয়া, / বাঙালির নব্য রসায়ন শুধু গরমিলে মিলাইয়া’। এ ছাড়া ছাড়া পারদ-সংক্রান্ত ১১টি মিশ্র ধাতব যৌগ আবিষ্কার, সম্পূর্ণ নতুন উপায়ে গবাদি পশুর হাড় পুড়িয়ে তাতে সালফিউরিক এসিড যোগ করে সুপার ফসফেট অব লাইম তৈরি করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন দেশি বিদেশি নাম করা জার্নালে প্রকাশিত হয় শতাধিক গবেষনাপত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে কোনওদিন বেতন নেননি। আবার গবেষণার কাজে তিনি নিজেকে চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখেন নি। যেখানেই বন্যা, মহামারি, দুর্যোগ সেখানেই ঝাপিয়ে পড়তেন।
ইংরেজ শাসকের রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কলকাতা টাউন হলে চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে রাউলাট আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভায় বলেন, ‘আমি বৈজ্ঞানিক, গবেষণাগারেই আমার কাজ, কিন্ত এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও দেশের আহবানে সাড়া দিতে হয়’। ইংরেজ শাসক তাঁকে ‘বিজ্ঞানীর বেশে বিপ্লবী’ বলত। একজন গবেষক, বিজ্ঞানের ইতিহাসবেত্তা, ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক এবং দেশপ্রেমিক প্রফুল্লচন্দ্র একজন বিরাট শিল্পোদ্যোক্তাও। তাঁর ব্যবসায়িক দূরদর্শিতায় মাত্র আটশ টাকা মূলধনে আপার সার্কুলার রোডের একটা ছোট্ট ঘরে গড়ে তোলেন বেঙ্গল কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিটিউক্যালস ওয়ার্কস।
কলকাতার কয়েকজন সম্পন্ন শিক্ষিত যুবককে উৎসাহিত করে ১৯৩৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় মেদিনীপুরের দাদনপাত্রবাড়ে নির্জন সমুদ্র উপকূলে গড়ে তোলেন ‘বেঙ্গল সল্ট কোম্পানি লিমিটেড’। তিনিই কোম্পানির চেয়ারম্যান হন। ম্যানেজিং এজেন্ট হন কলকাতার হাটখোলা দত্ত পরিবারের মনুজেন্দ্র দত্ত। প্রায় ১ হাজার ছ’শো একর জমির উপর বিশালাকৃতির একাধিক ঘেড়িতে নুন মিশ্রিত জল জমিয়ে সূর্যের তাপকে কাজে লাগিয়ে লবণ তৈরির কাজ শুরু হয়। কারখানায় কাজ করতেন বিভিন্ন রাজ্যের প্রায় পাঁচশো শ্রমিক। এরপর একে একে বেঙ্গল পটারিজ, বেঙ্গল এনামেল, ক্যালকাটা সোপ ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারিজ মার্কেন্টাইল মেরিন ইত্যাদি। নিজের জেলা খুলনায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রফুল্লচন্দ্র কটন টেক্সটাইল মিল পরবর্তীতে খুলনা টেক্সটাইল মিল। বলাই বাহুল্য, এসব সংস্থা এখন অস্তিত্বহীন, শুধুমাত্র কলকাতার বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যালস কোনোমতে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।