‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে কোনও তাড়াহুড়ো নয়। অনেক দিন ধরে ভেবে-চিন্তে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনী ইস্তাহার বানিয়েছে বিজেপি। রবিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের হাত দিয়ে সেই ইস্তাহার প্রকাশ করার কথা পদ্মশিবিরের। সূত্রের খরব, এবার বাংলার বিধানসভা ভোটে যে ইস্যুগুলিকে পাখির চোখ করেছে বিজেপি, সেগুলিই গুরুত্ব পেয়েছে ইস্তাহারে।
কর্মসংস্থান- বাংলায় এবারের ভোটে বিজেপি-র সবচেয়ে বড় ইস্যু হল কর্মসংস্থান। গত দশ বছরে এই রাজ্যে উল্লেখযোগ্য কোনও বিনিয়োগ হয়নি শিল্পে। উল্টে ধুঁকতে থাকা কল-কারখানাগুলো একে-একে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজের খোঁজে বাংলার ছেলেমেয়েদের যেতে হচ্ছে ভিন্রাজ্যে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর বিজেপি। ক্ষমতায় এলে এক কোটি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি থাকছে ইস্তাহারে।
শিল্পায়ন- শিল্প না হলে কর্মসংস্থান সম্ভব নয়। তাই এই রাজ্যে শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আনা বিজেপি-র লক্ষ্য। দক্ষিণবঙ্গে চটশিল্পের পুনরুজ্জীবন থেকে পশ্চিমাঞ্চলে নতুন শিল্প স্থাপনের কথা থাকবে ইস্তাহারে। কিন্তু শিল্প করার ইচ্ছা থাকলেই হয় না, এর জন্য চাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এই রাজ্যে শিল্পায়নের লক্ষ্যে তাই বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে পৃথক একটি নীতি আয়োগ গড়ার কথা ভাবছে। কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারের মধ্যে কো-অর্ডিনেট করে বিনিয়োগ আনাই কাজ হবে এই নীতি আয়োগের। উল্লেখ্য, প্রথম দফার মেয়াদের গোড়ায় যোজনা কমিশন তুলে দিয়ে নয়া প্রতিষ্ঠান নীতি আয়োগ গঠন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই এর বিপক্ষে। নীতি আয়োগ তৈরির আগে ২০১৪-র ডিসেম্বরে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে মোদী যে বৈঠক করেছিলেন, তাতেও যাননি মমতা। পরবর্তী কালেও একাধিক বার নীতি আয়োগের বৈঠক এড়িয়ে গিয়েছেন তিনি। মমতার মতে, নীতি আয়োগের হাতে যেহেতু আর্থিক সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ করার কোনও ক্ষমতা নেই, সেহেতু এই বৈঠকে কাজের কাজ কিছু হয় না।
সিন্ডিকেটরাজ উৎখাত- বিজেপি মনে করে, তোলাবাজি আর সিন্ডিকেট-রাজের জন্যই বাংলায় নতুন বিনিয়োগ আসছে না। তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষের এটাই সবচেয়ে বড় অভিযোগ। বিজেপি-র ইস্তাহারে তাই ‘কাটমানি’ আর দুর্নীতির অভিযোগের দ্রুত তদন্ত করার আশ্বাস থাকছে। সারদা, রোজ ভ্যালির মতো চিট-ফান্ড দুর্নীতির তদন্তগুলিও শেষ করতে চায় বিজেপি।
শিক্ষা- স্কুলের পাঠ্যবই থেকে জাতীয়তাবাদ বিরোধী, হিন্দুত্ব বিরোধী এবং জিহাদ-পক্ষে কিছু থাকলে তা ছ’মাসের মধ্যে সরিয়ে ফেলা হবে। পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রকে রাজনীতি-মুক্ত করার উপরে জোর দেবে বিজেপি।
লাভ জিহাদ বিরোধী আইন- বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, লাভ জিহাদ রুখতে বিশেষ আইন আনার কথা ভাবছে তারা। বিজেপি নেতৃত্বের মতে, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, হুগলি, জলপাইগুড়ি, মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় ‘লাভ-জিহাদে’র ঘটনা আকছার ঘটছে।
ধর্মীয় পর্যটন- এই রাজ্যে পর্যটনশিল্পের উপর জোর দিতে চায় বিজেপি। দার্জিলিং, সুন্দরবনের মতো নৈসর্গিক জায়গাগুলির পাশাপাশি কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বর, তারাপীঠ, কঙ্কালীতলা, মায়াপুরের মতো জায়গাগুলিতে পর্যটন শিল্পের প্রসারে পরিকাঠামো উন্নয়নে জোর দেওয়া হবে। দুই বাংলার শক্তিপীঠগুলোকে জোড়ার প্রকল্প থাকছে ইস্তাহারে।
মতুয়াদের নাগরিকত্ব- গত লোকসভা ভোটের আগে ঠাকুরনগরে এসে মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এরপর নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) সংসদে পাশ হয়েছে। কিন্তু এখনও তা কার্যকর হয়নি। এই প্রেক্ষিতে দ্রুত মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকছে বিজেপি-র ইস্তাহারে। এছাড়া মতুয়া দলপতিদের জন্য পেনশন, শরনার্থী কল্যাণে আলাদা কিছু প্রকল্পের কথাও ইস্তাহারে উল্লেখ থাকবে বলে সূত্রের খবর।
নজরে উত্তরবঙ্গ- উত্তরবঙ্গের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায় বিজেপি। সেখানে শুধু নতুন শিল্প আনাই নয়, পরিকাঠামোগত উন্নয়নেও জোর দিতে চায় বিজেপি। চায়ের পাশাপাশি উত্তরের পাট ও তামাক চাষের উন্নতিতেও পরিকল্পনার কথা থাকবে ইস্তাহারে। বিশেষ করে পর্যটন ক্ষেত্রে উত্তরবঙ্গের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আনছে বিজেপি।
এছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলি বাংলায় চালু করার কথা থাকছে ইস্তাহারে। এর মধ্যে ‘আয়ুষ্মান ভারত’ যেমন আছে তেমনই রয়েছে ‘কৃষক সম্মান নিধি’ প্রকল্পের কথা। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য সপ্তম বেতন কমিশন চালুর প্রতিশ্রুতিও ইস্তাহারে রাখছে বিজেপি। থাকছে সীমান্ত সুরক্ষা বাড়ানোর পাশাপাশি অনুপ্রবেশ রোখার মতো বিষয়গুলিও। এককথায়, কর্মসংস্থান থেকে সামাজিক সুরক্ষার মতো জরুরি বিষয়গুলি এবারের ভোটে বিজেপি-র ইস্যু।