ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসাব, না নীতিগত অবস্থান - দলত্যাগের কারণ এখন অবান্তর

শাসকদলে এখন যেন মুষল পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে

বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই মমতা শিবিরে ধস নামছে

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া না নীতিগত সংঘাত

দলত্যাগের কারণ বিষয়ে প্রশ্নটা এখন অবান্তর হয়ে গিয়েছে

তপন মল্লিক: এই রাজ্যে ৩৪ বছরের একটানা শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল যে দল, আজ সেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসে যেন মুষল পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। নতুন বছরে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সেই মহারণ যত এগিয়ে আসছে, ততই যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিবিরে ধস নামতে শুরু করেছে। মেদিনীপুরের কলেজ মাঠে অমিত শাহের সভামঞ্চে শুভেন্দু অধিকারী যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে যোগ দেবেন তা আগেই জানা ছিল। ওই মঞ্চে যে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ, বিধায়ক-সহ কয়েকজন প্রাক্তন জনপ্রতিনিধি, দলের বিভিন্ন স্তরের পদাধিকারী ও সিপিএম, সিপিআই ও কংগ্রেসের বিধায়করাও বিজেপিতে যোগ দেবেন সেটাও পুরনো খবর। শুভেন্দু ছাড়া তৃণমূলের আরও সাত বিধায়ক ওইদিন ঘাসফুলের সংসার ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। তবে শুভেন্দুর নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুর থেকে উত্তর কাঁথির তৃনমূল বিধায়ক বনশ্রী মাইতি ছাড়া আর কেউ দলত্যাগ করেননি।  

তবে এটাও ঠিক যে শুভেন্দুকে অনুসরণ করে বিভিন্ন জেলায় একের পর এক ছোট-বড় নেতা-নেত্রী দল ছাড়তে শুরু করেছেন। ধরে নেওয়া যায় এদের সবারই লক্ষ্য গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানো। দলত্যাগের লাইনে আছেন আরও অনেকে। ধরে নেওয়া হচ্ছে মমতার পরিবার ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে ভিড়তে পারেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপক হালদার, অনন্ত দেব অধিকারী, বাচ্চু হাঁসদা, রণজিৎ মণ্ডলের মতো নেতারাও। বেশ কিছুদিন ধরেই এদের কথা থেকে বেরিয়ে আসছে দলবিরোধী চড়া সুর। তৃণমূল পরিবারে যে ফাটল ধরেছে, তা সময় যত এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে। সংসারের ভাঙন সামলাতে দলনেত্রী কিংবা অন্য নেতারা যাই বলুন না কেন তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।

Latest Videos

যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিবিরে চির ধরেছিল অনেক আগেই। ২০১৪ সালের পর মুকুল রায়, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো ছায়াসঙ্গীরা ছাড়াও তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপি শিবিরে এসেছে সৌমিত্র খান, অনুপম হাজরা প্রমুখ। যেদিন এঁরা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিল সেদিন থেকেই দলের ভিতে ধাক্কা লাগা শুরু হয়েছিল। তবে শুভেন্দু অধিকারীর দলত্যাগ অবশ্যই নির্বাচনের মুখে মমতার পক্ষে বড় ধাক্কা। এছাড়া অমিত শাহের বঙ্গ সফরের প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা।

গত কয়েকদিন ধরে যেভাবে তৃণমূল ছাড়ার হিড়িক পড়েছে তাতে স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও উদ্বেগ বেড়েছে। নেত্রী তড়িঘড়ি কালীঘাটে নিজের বাড়িতে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠক ডেকে কোর কমিটির নেতাদের ইতিবাচক বার্তা দিয়ে জানান যে, একুশের জয় নিশ্চিত। কেবল সকলকে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। রাজ্যের উন্নয়নমূলক কাজ আরও বেশি করে মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে। জনসংযোগ বাড়াতে হবে। মানুষের কাছে গিয়ে তাঁদের সমস্যা জানতে হবে। সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। অন্যদিকে তাঁর দলের বিক্ষুব্ধদের উদ্দেশে কড়া বার্তা দেন, ‘কে এল, কে গেল তাতে কিছু এসে যায় না। নেতা নয়, কর্মীরাই দলের আসল সম্পদ। তাই চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। জয় নিশ্চিত’।

প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই একদিন তাঁর পুরনো দল কংগ্রেসে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি রাজ্যের কংগ্রেসকে সিপিএমের বি-টিম আখ্যায়িত করেছিলেন। পরবর্তীতে কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস গড়ে দীর্ঘ লড়াই করে চৌত্রিশ বছরের বাম দুর্গে আঘাত হেনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। সেই মমতার দলে আজ শুভেন্দু অধিকারী বিদ্রোহী, দেখা গেল একে একে ভিতরের ক্ষোভ উগরে আরও অনেক  মন্ত্রী, বিধায়ক, নেতা-নেত্রীরাও একই পথের অনুসারী। তবে দুই প্রতিবাদের মধ্যে যে ফারাক আছে সেকথা মানতে হয়।

শুভেন্দুর মতো প্রায় সব বিদ্রোহী ও দলত্যাগীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভের ভাষা প্রায় এক। তাঁদের মূল বক্তব্যের বিষয়বস্তুও প্রায় এক। এমনকী আক্রমণের তিরও একই অভিমুখে। তৃণমূল কংগ্রেসে আচমকা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থান ঘিরে দিনের পর দিন প্রশ্ন জমা হয়েছে। ধীরে ধীরে সেটা দানা বেঁধে ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। এরপরে দলের সাংগঠনিক কাজে ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোরের সক্রিয়তা সেই ক্ষোভকে বাড়িয়ে দিয়ে বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে।

বিদ্রোহীরা দলে নিজেদের  কোণঠাসা ভাবতে ভাবতে শেষমেশ প্রকাশ্যে দলের বিরুদ্ধে সুর চড়ান। শুভেন্দুর পদক্ষেপ তাঁদের একাংশকে যথেষ্ট উৎসাহিত করে। এই ঘটনা ত্বরান্বিত হতে হতেই বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে ওঠে। রাজ্যের দখল নিতে ঝাপিয়ে পড়েছে বিজেপি। তৃণমূলে বিক্ষোভ-বিদ্রোহ যত বাড়বে ততই তাঁদের সুবিধা। কেবল তাই নয়, বিদ্রোহীদের দলে পেতে বিপুল আগ্রহী তারা। এমন একটি ‘মওকা’ পেয়ে বিদ্রোহীরা যে সেখানেই ভিড়বে দলীয় রাজনীতিতে সেটাই স্বাভাবিক। বিদ্রোহীদের দলত্যাগ কিংবা অন্যান্য পদ থেকে ইস্তফা কি কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার হিসেব, নাকি নীতিগত কোনও অবস্থান থেকে? এ প্রশ্ন এই মুহুর্তে অবান্তর।

Share this article
click me!

Latest Videos

পুলিশি অভিযানে বড়সড় সাফল্য! উত্তেজনা রানাঘাটে, দেখুন | Ranaghat News Today
আর ৮ মাস! জুলাই-অগাস্টে রাজ্যে অকাল ভোট হতে চলেছে! জানালেন BJP সাংসদ | BJP News | Samik Bhattacharya
TMC-কে ভোট দিলেই মিলছে ঠোঙা ভর্তি মুড়ি ও চানাচুর! শোরগোল মেদিনীপুরে | Midnapore | WB By election
অসাধ্য সাধন! যথেষ্ট পরিকাঠামো না থাকার সত্ত্বেও ৮০০ গ্রামের শিশুকে বড় করে তুলল বারাসাত মেডিক্যাল
'পুলিশ ও তৃণমূলের গুণ্ডারা সর্বত্র ভোট লুট করেছে' মারাত্মক অভিযোগ সুজন চক্রবর্তীর