তিন দফার নির্বাচনে ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকজনের
ভারতের আর কোনও রাজ্যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত হিংসা দেখা যায় না
কেন বাংলা এই বিষয়ে ব্যতিক্রম
এর পিছনে কারণ কী শুধুই রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা
শমিকা মাইতি: জল চাই, বিদ্যুৎ চাই, এমনকী কাজ চাওয়ার দাবিও নয়। খাস কলকাতার বুকে তৃণমূলের মিছিলে কিছু দিন আগে শোনা গেল ‘গোলি মারো’ স্নোগান। বীভৎস সুন্দর এই শব্দবন্ধটা ভারী পছন্দ হয়েছে প্রতিপক্ষ দলের। তাই চন্দননগরে সাংসদ-বিধায়কের উপস্থিতিতে বিজেপির মিছিলেও স্লোগান উঠল, ‘গোলি মারো’। এই দু্’টো খণ্ডচিত্রই বুঝিয়ে দেয় ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আবহে পশ্চিমবঙ্গে হিংসার রাজনীতি কেমন জাঁকিয়ে বসেছে।
বস্তুত, আজ বলে নয়, সেই ষাটের দশক থেকে হিংসার রাজনীতি দেখছে বাংলা। নকশাল আন্দোলন এবং তা দমনের জন্য কংগ্রেস সরকারের নিপীড়ন-অত্যাচার দেখেছে বাঙালি। ১৯৭৭ সালে বামেরা ক্ষমতায় আসার পরে হিংসার এই রাজনীতি আরও সুসংগঠিত হয়েছে। পার্টি-বিরোধী কোনও কিছু শুনব না- এই হল মোদ্দা কথা। গণতন্ত্রের বুকে শেল বিঁধিয়ে মরিচঝাঁপি থেকে সাঁইবাড়ি থেকে ছোট আঙারিয়া থেকে নন্দীগ্রাম-একের পর এক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ভোটের আগে প্রতিপক্ষের বাড়িতে সাদা থানা পাঠিয়ে কী ভাবে ভয় দেখানো হত, সেই কাহিনী আজও শোনা যায় কান পাতলে। ৩৪ বছরের এহেন বামশাসনের অবসান ঘটিয়ে, অনেক স্বপ্ন দেখিয়ে, ২০১১ সালে বাংলার বুকে ক্ষমতায় এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর দল তৃণমূলও কোনও ‘পরিবর্তন’ আনতে পারল না হিংসার রাজনীতিতে। বামেদের ছত্রছায়ায় থাকা ‘মাসল-ম্যান’রা একে-একে চলে এল তৃণমূলের ছাতার তলায়। কেউ নেতা হয়ে গেল, কেউ তোলাবাজি-সিন্ডিকেট করে বিশাল সাম্রাজ্য বানাল। কেউ আবার পার্টি করে একদিন অনেক টাকা বানানোর স্বপ্ন দেখল। এইখানেই উঠে আসছে দ্বিতীয় তত্ত্ব, বেকারত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার সমানুপাতিক সম্পর্কের বিষয়টি। ঠিক মতো কর্মসংস্থান হলে, যুবসমাজ গঠনমূলক কাজে যুক্ত থাকলে পার্টির দাদাদের এত রমরমা হত না। এলাকা দখল, পঞ্চাযেত দখলের জন্য এত মারামারি কেন? সবই তো সেই টাকা খাওয়ার গল্প। হাতে টাকা আসার সৎ উপায় থাকলে এসবের দরকার পড়ত না। তাই অনুদান ধরিয়ে ক্লাবের ছেলেদের দলে টানায় যতটা আগ্রহ মমতার সরকারের- কারখানা গড়ার ব্যাপারে ততটা নয়।
গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের কাজ হয়নি বললে চলে। সরকারি চাকরি-বাকরি নেই। সব মিলিয়ে বেকারত্বের চূড়ান্ত দশা। স্বাভাবিক ভাবে ‘পার্টি’ করার প্রচুর লোক। বরং পার্টি নেই। বাম ও কংগ্রেস প্রায় নিষ্ক্রিয়। সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে বাংলায় উঠে এসেছে বিজেপি। সর্বভারতীয় এই দলের টাকার অভাব নেই। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার উপরি সুবিধা আছে। তৃণমূল-বিরোধীরা একে-একে নাম লেখাতে শুরু করল বিজেপিতে। আবার শুরু হল ক্ষমতা দখলের লড়াই।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের কথা ধরা যাক। এখানকার বাহুবলী নেতা অর্জুন সিংহ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে এই এলাকা রাজনৈতিক ভাবে অশান্ত হয়ে উঠেছে। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুর থেকে বিজেপির টিকিটে জিতে সাংসদ হন অর্জুন। তারপর থেকে নিত্য বোমাবাজি চলছে ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া জগদ্দল এলাকা। দোকানপাট বন্ধ। মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের। গত জুলাই মাসে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হন টিটাগড়ের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্ল। সেই নিয়ে তৃণমূল-বিজেপিতে চাপানউতোর চলছে এখনও।
এরই মধ্যে বেজে উঠেছে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট। উত্তর থেকে দক্ষিণ- হিংসার রাজনীতিতে তেতে উঠেছে বাংলা। উত্তরবঙ্গে বিজেপির উত্তরকন্যা অভিযান ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলা হয়েছে। শুভেন্দু অধিকারী-সহ কয়েকজন তৃণমূল নেতার বিজেপিতে যোগদানের পর মেদিনীপুরেও বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে চলেছে। গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপি কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগ উঠছে। কোচবিহারের দিনহাটায় বিজেপির মণ্ডল সভাপতি অমিত সরকার, নদিয়া জেলার শান্তিপুরের দীপঙ্কর বিশ্বাস ও প্রতাপ বর্মন, পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির যুবক লালমোহন সরেন, কেশিয়াড়িতে বিজেপির সক্রিয় কর্মী মঙ্গল সরেন, বীরভূমের দুবরাজপুর ব্লকের ফকিরবেরা গ্রামের বিজেপি কর্মী পতিহার ডোম, হুগলির গোঘাটের বদনগঞ্জ এলাকায় বিজেপি সমর্থক পরিবারের কর্ত্রী মাধবী আদক- রাজনৈতিক হামলায় মৃতের তালিকা বাড়ছে বিজেপির।
এই প্রেক্ষিতে হিংসার রাজনীতি থেকে বাংলাকে মুক্ত করার ডাক দিয়েছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। রাজ্যসভার সাংসদ তথা বিজেপি প্রার্থী স্বপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে হিংসার রাজনীতি দেখে ক্লান্ত ও বিরক্ত। বিজেপি ক্ষমতায় এলে হিংসার সংস্কৃতির অবসান ঘটাবে।’