দক্ষিণবঙ্গের ১০টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা কেন্দ্র- এক নজরে

  • নন্দীগ্রামই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে নজরকাড়া কেন্দ্র 
  •  সিঙ্গুরের রাজনীতিতে  প্রাধান্য পেয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব 
  •  হুগলি লোকসভার অন্তর্ভুক্ত ৭ বিধানসভাই পাবে বিজেপি  
  •  ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে পাল্লা ভারী বলে দাবি করে আসছে পদ্ম শিবির 
     

Asianet News Bangla | Published : May 2, 2021 1:15 AM IST / Updated: Jun 01 2021, 01:10 PM IST

তাপস দাশঃ- সকাল থেকেই  শুরু হয়ে যাবে হিসেব নিকেশ। যে হিসেব স্থির করে দেবে আগামী পাঁচ বছর বাংলা থাকবে কোন শাসনের অধীনে। এবারের নির্বাচন ছিল অভূতপূর্ব, বহু অর্থেই। নির্বাচন হয়েছে ৮ দফায়। দলত্যাগী বিধায়ককে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজের কেন্দ্র বদল করেছেন। এই নির্বাচনে অতি গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কেন্দ্রে। দক্ষিণবঙ্গের ১০টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ আসনের আলোচনা ও খতিয়ান।  

আরও পড়ুন, অপেক্ষা শেষ, কে হবে বাংলার মুখ, মোদী না মমতা  

 

 

১. নন্দীগ্রাম
 
পূর্ব মেদিনীপুরের এই বিধানসভা এলাকা বছর দশেক আগে সারা পৃথিবীর নজর কেড়েছিল, জমি আন্দোলনের সুবাদে। সে এলাকা ফের একবার জাতীয় স্তরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নজরকাড়া হয়ে উঠেছে। নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা পূর্ব মেদিনীপুর সহ বেশ কিছু এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা শুভেন্দু অধিকারী বেসুরে গাইতে শুরু করেন নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। ডিসেম্বরে তিনি দল বদল করে বিজেপিতে যোগ দেন। নন্দীগ্রামে তাঁকেই প্রার্থী ঘোষণা করে গেরুয়া শিবির। এর পর ওই এলাকায় জনসভা করতে গিয়ে মঞ্চ থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাটকীয় ভাবে ঘোষণা করেন তিনি নন্দীগ্রাম কেন্দ্র থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এই ভোটে। এর পরেই পারদ চড়তে থাকে নন্দীগ্রামে। শুভেন্দুর মুখে যত্রতত্র শোনা যেতে থাকে জয় শ্রীরাম ধ্বনি, তৃণমূল কংগ্রেস অধিকারী শিবিরকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দেয়। প্রাথমিক ভাবে শোনা গিয়েছিল, নন্দীগ্রামের মুসলিম ভোটকে সংহত করতে সেখানে প্রার্থী দেবে আব্বাস সিদ্দিকির ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট। পরে সেখানে প্রার্থী দেয় সিপিএম। তাদের প্রার্থী মেদিনীপুরের ভূমিকন্যা মীনাক্ষী মুখার্জি। নিঃসন্দেহে, নন্দীগ্রামই এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে নজরকাড়া কেন্দ্র। 

 

 

২. সিঙ্গুর

বাংলায় ২০১১ সালের পালাবদলের মূল কেন্দ্র যদি নন্দীগ্রাম আন্দোলন হয়ে থাকে, তবে তার সূচনা হয়েছিল সিঙ্গুরে। তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে থাকা সিঙ্গুরের রাজনীতিতে গত কয়েক বছরে প্রাধান্য পেয়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। একদা মাস্টারমশাই-ছাত্র রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ও বেচারাম মান্নার সম্পর্ক ক্রমশ সাপে-নেউলে হয়ে ওঠে। ভোটের আগে দল পাল্টান রবীন্দ্রনাথ। নিজেদের তৈরি করা নিয়ম ভেঙে প্রায় নবতিপর মাস্টারমশাইকে এই কেন্দ্রে প্রার্থী করে বিজেপি। উল্টোদিকে তৃণমূল কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছে বেচারাম মান্নাকেই। এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য। এসএফআইয়ের এই নেতাকে দলের তরুণ মুখ হিসেবে প্রোজেক্ট করছে বামেরা। সিঙ্গুরে এখন শিল্পের সপক্ষে দুটি দল, সিপিএম ও বিজেপি। এই সমীকরণ ভোটের ফলকে কোনদিকে প্রভাবিত করে, সে দিকে নজর থাকবে। 

আরও পড়ুন, Bengal Election Counting Live- বাংলা এবার কার দখলে, ফল জানাতে তৈরি এশিয়ানেট নিউজ বাংলা 

 

৩. জামুড়িয়া

কৌতূহলের শেষ নেই পশ্চিম বর্ধমান জেলার জামুড়িয়া কেন্দ্র ঘিরে। তৃণমূল বনাম বিজেপি লড়াই নয়, এখানে আগ্রহের সঞ্চার ঘটেছে যে প্রার্থীকে ঘিরে, তিনি সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত সিপিএম প্রার্থী। ঐশী ঘোষের নাম বহুল পরিচিত, জেএনইউ-তে তাঁর প্রহৃত হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশাল মিডিয়ায়। সেই ঐশীকে নিজেদের শক্তিশালী দুর্গ জামুরিয়া কেন্দ্রে প্রার্থী করেছে বামেরা। অন্য দলগুলির বক্তব্য এলাকার সমস্যা সম্পর্কে ঐশী অবহিত নন। গত লোকসভা নির্বাচনে অবশ্য এখানে সিপিএমের ফল ছিল হতাশাজনক। নির্বাচিত সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় এই বিধানসভা কেন্দ্রে বাম প্রার্থীর ৪ গুণেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন। এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হরেরাম সিং ও বিজেপির প্রার্থী তাপস রায়।

 

৪. চুঁচুড়া

সাংসদকে বিধানসভা কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে, এরকম উদাহরণ বেশ কয়েকটি রয়েছে গেরুয়া শিবিরে। চুঁচুড়া তেমনই একটি কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে প্রার্থী হয়েছেন হুগলির সাংসদ লকেট চ্যাটার্জি। এই টলি অভিনেত্রীর দাবি, সাতে সাত। অর্থাৎ, হুগলি লোকসভার অন্তর্ভুক্ত সাতটি বিধানসভাই পাবে বিজেপি। তবে ঘটনা হল, প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ হয়েছে হুগলি জেলায়, হয়েছে ভাঙচুর, বিক্ষোভ। বেশ কিছুদিন এলাকাতে দেখাই যায়নি লকেটকে। লকেট পরে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন, এক লক্ষ ভোটের লিড থাকবে চুঁচুড়া কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসর প্রার্থী হয়েছেন অসিত মজুমদার। ফরোয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী প্রণব কুমার মণ্ডল। 

 

 

৫. বাঁকুড়া

বাঁকুড়া কেন্দ্র নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে মান অভিমানের সূচনা হয়েছিল। এই কেন্দ্রে গতবারের কংগ্রেস বিধায়ক শম্পা দরিপা তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। প্রার্থী হবার দৌড়ে তিনিই এগিয়েছিলেন বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব এই কেন্দ্রে প্রার্থী করে রুপোলি পর্দার অভিনেত্রী সায়ন্তিকা ব্যানার্জিকে। এ নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ তৈরি হয়। শম্পা দরিপার অনুগামীরা বিক্ষোভ দেখান, কেন বহিরাগতকে প্রার্থী করা হবে সে নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরবর্তীতে অবশ্য সে সংকট মিটে যায়। শম্পার বাড়িতে গিয়ে জলখাবার খান সায়ন্তিকা, শম্পাও জানান একযোগে লড়বেন। এই কেন্দ্রে ভিতরে ভিতরেও সংকট মিটেছে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। বাঁকুড়া বিধানসভায় বিজেপির প্রার্থী নীলাদ্রিশেখর ডানা ও কংগ্রেস প্রার্থী রাধারাণী ব্যানার্জি। 

 

৬. রাণীবাঁধ

আগের বারের প্রার্থীরাই একই কেন্দ্রে রয়েছেন, কিন্তু তাঁদের দল বদল ঘটে গিয়েছে, এমন বিধানসভা আসন এবার প্রচুর। রাণীবাঁধ তার ব্যতিক্রম। এই কেন্দ্রের মূল তিনটি দলের প্রার্থী ও তাঁদের প্রতীক একই রয়েছে।  গত বছর রাণীবাঁধ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের জ্যোৎস্না মাণ্ডি। হারিয়েছিলেন সিপিএমের দেবলীনা হেমব্রমকে। তৃতীয় স্থানে ছিলেন বিজেপির ক্ষুদিরাম টুডু। এবারও এই তিনজনের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে রাণীবাঁধ কেন্দ্রে। 

৭. বাঘমুণ্ডি

পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বাঘমুণ্ডির দিকে নজর থাকবে যে কারণে, তা হল, এই কেন্দ্রে প্রার্থী দেয়নি ভারতীয় জনতা পার্টি। এই আসন তারা ছেড়েছে তাদের সহযোগী আজসু বা অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন পার্টিকে। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করেছিলেন কংগ্রেসের নেপাল মাহাতো। এবারও এই কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী হয়েছেন তিনিই। তৃণমূল কংগ্রেসের এবারের প্রার্থী সুশান্ত মাহাতো। গতবার বিজেপি এখানে আলাদা প্রার্থী দিয়েছিল, এবার তাদের সমর্থিত আজসু পার্টির প্রার্থী আশুতোষ মাহাতো। 

৮. ঝাড়গ্রাম

ঝাড়গ্রাম জেলার ঝাড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রটি এবারের বিধানসভা নির্বাচনে সকলেরই নজরে। এবার এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন বীরবাহা হাঁসদা। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোট ও ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তিনি ঝাড়খণ্ড পার্টি নরেনের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নরেন হাঁসদা ও চুনীবালা হাঁসদার কন্যা  বীরবাহা হাঁসদা সাঁওতালি সিনেমা জগতে পরিচিত নাম। তিনি এ বছরই তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। এই কেন্দ্রে সিপিএমও মহিলা প্রার্থী দিয়েছে। তবে তিনি এলাকার নন। প্রাক্তন এসএফআই নেত্রী মধুজা সেনরায় ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী। অন্যদিকে বিজেপির প্রার্থী এই কেন্দ্রে সুখময় শতপথী। তিনি বিজেপির ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির সভাপতি। এই কেন্দ্রে পাল্লা ভারী বলে দাবি করে আসছে পদ্ম শিবির। 

 


৯. কৃষ্ণনগর উত্তর 

এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বড় কৌতূহল কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্র নিয়ে। এখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী দুই মেরুর। একজন নবাগত, একজন পোড় খাওয়া। একজনের রাজনীতিই একমাত্র পেশা, অন্যজন রুপোলি পর্দার। একজন বয়স্ক- প্রাজ্ঞ, অন্যজন তারুণ্যনির্ভর। এই কেন্দ্রে লড়াই হয়েছে মুকুল রায়ের সঙ্গে কৌশানি মুখার্জির। রাজ্যসভার সাংসদ মুকুল রায়কে কৃষ্ণনগর দক্ষিণ কেন্দ্রে প্রার্থী করে আসনটি নিশ্চিত করতে চেয়েছে গেরুয়া শিবির। তৃণমূল পাল্টা চালে এখানে প্রার্থী করেছে অরাজনৈতিক মুখ কৌশানিকে। ধার-ভারের দিক থেকে হিসেব করলে এ আসনের ফল কী হবে, সকলে এক প্রকার ধরেই নিয়েছেন। তবে কৌশানির দাবি ছিল, খেলা হবে - তিনিই জিতবেন। 

১০. বোলপুর

মন্ত্রীমশাইয়ের বিধানসভা আসন বোলপুর ঘিরেও কৌতূহল রয়েছে। এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে এবার অনেকটাই দলীয় লড়াইয়ের চেয়ে আগ্রহ তৈরি হয়েছে বিশ্বভারতী ঘিরে। রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নের প্রকল্প ঘিরে যে ডামাডোল তৈরি হয়েছে, উপাচার্যের ভূমিকা নিয়ে যে সব প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তার সঙ্গে যোগ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে দলীয় রাজনীতির। সে কারণেই সারা ভারতেরই চোখ রয়েছে এই দিকে। বিজেপি এখানে প্রার্থী করেছে অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়কে। তিনি দলের শিক্ষিত-বুদ্ধিমান মুখ হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে এই কেন্দ্রে আরএসপির তপন হোড় প্রার্থী হয়েছেন। ২০০৬ সালের বিধায় তপন হোড় ২০১১ ও ২০১৬ সালে চন্দ্রনাথ সিংহের কাছে হেরে গিয়েছিলেন।  

Share this article
click me!