অযোধ্যায় হদিশ মিলল 'রাম-সীতা-লক্ষণ'-এর, অভাব-অনাহারের গ্রামে চুটিয়ে চলছে 'মালতির স্কুল'

  • অভাব-অনাহার এখানে নিত্যসঙ্গী 
  • তবু এখন মনের জোরে এগিয়ে চলেছে জিলিংসেলিং
  • জিলিংসেলিং-কে এখন পথ দেখাচ্ছে মালতি-বাঙ্কা-ভরত
  • অযোধ্যা পাহাড়ে এরাই এখন যেন রাম-সীতা-লক্ষণ

চারিদিকে যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই প্রখর রোদে পুড়ে যাওয়া গাছপালা আর কাঁটা গাছের ঝোপঝাড়। অযোধ্যার হিলটপে জিঞ্জেস করেছিলাম জিলিংসেলিং গ্রামের ঠিকানা। কেউ ঠিক করে রাস্তাটা ঠাওরাতে পারল না। কারণ, অযোধ্যার অধিকাংশ মানুষের কাছে জিলিংসেলিং একটা 'হারিয়ে যাওয়া গ্রাম'। অযোধ্যার হিলটপে থাকা অধিকাংশ মানুষ বলে- 'একটু এগিয়ে যান, ওই- যাকে জিগাস করবেন, সেই বেটাই বলে দেবে।' অযোধ্যা টিলার উপরে রাস্তার চড়াই-উতরাই ভেঙে ৩০ মিনিট যাওয়ার পরও জিলিংসেলিং গ্রামের কোনও পথ নির্দেশ চোখে পড়ল না। ঝালদা থেকে মুরুগমা-সহ আরও বেশকিছু স্থানে যাওয়ার রাস্তার দিক চিহ্ন রয়েছে বটে, কিন্তু জিলিংসেলিং-এ যাওয়ার কোনও রাস্তার খোঁজ মিলছিল না। অযোধ্যা পাহাড়ের উপরে একটা সমতলভূমির মতো জায়গায় কিছু ছেলের দেখাও মিলল। তারা শুধু বলতে পারল আরও অন্তত ১০ কিলোমিটার রাস্তা যেতে হবে। সামনে রাস্তার একাধিক বাঁক ও চৌমাথা রয়েছে, সেখানে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। কেন জিলিংসেলিং গ্রামের খোঁজ। কারণ, অযোধ্যা পাহাড়ে যে সব গ্রাম অনুন্নয়ন এবং অভাবের তাড়নায় শিরোনামে উঠে এসেছিল তারমধ্যে জিলিংসেলিং ছিল এক নম্বরে। একটা সময় এখানে মানুষকে বন থেকে পাতা সংগ্রহ করে ক্ষিদে নিবারণও করতে হয়েছিল। এরসঙ্গে ছিল মাওবাদীদের দাপট। ২০১০ সালেই জিলিংসেলিং-এর সামনেই ৭ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা ও নেত্রীকে গুলি করে খুন করেছিল মাওবাদীরা। ২০২১ সালে তাই আমাদের যাত্রা জিলিংসেলিং-এর উদ্দেশে। প্রত্যক্ষ করা কতটা উন্নয়নের আওতায় পড়েছে জিলিংসেলিং-এর মানুষ। 

Latest Videos

অনেক মানুষের কাছে রাস্তার হদিশ জিজ্ঞেস করতে করতে অবশেষে পৌঁছানো গেল জিলিংসেলিং-এ। রাস্তার চড়াই ভেঙে গাড়িটা একটা সমতলের মতো রাস্তায় দাঁড় করাতেই আশপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল বেশকিছু মানুষ। বনের বুক চিরে কংক্রিট ঢালাই-এর রাস্তা উন্নয়নের ইঙ্গিত দিচ্ছে বটে, কিন্তু চারপাশে থাকা বাড়িগুলোর চেহারার দিকে চোখ ফেললেই বোঝা যায় যে ভালো নেই জিলিংসেলিং। আদিবাসীদের এই এলাকায় একটা জিনিস সবসময় চোখে পড়ে যেটা সেটা হল মাটির বাড়ির দেওয়াল। সুন্দর করে নিকানো- যেন মনে হবে কোনও শিল্পি তুলির টানে সাজিয়ে তুলেছেন। আদিবাসী রমণীদের বাড়ি নিকানো-র একটা প্রাচীন ঐতিহ্যের মুন্সিয়ানা রয়েছে- সেই দিয়েই এঁরা সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে পারেন বাড়িগুলো। কিন্তু, বাড়ির চালের দিকে নজর করলেই বোঝা যায়- কার কতটা আর্থিক সামর্থ্য। জিলিংসেলিং-এর গ্রামে যাঁদের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো তাদের বাড়ির চালে টালি। আর যাদের আর্থিক অবস্থা এক্কেবারে তলানিতে তাদের বাড়ির চাল হয় ছেড়া ত্রিপল বা খড় অথবা বনের পাতা আর বাঁশকে বাতার মতো কেটে বিছানো। 

এই জিলিংসেলিং গ্রামেই দেখা মিলল মালতির। বছর কুড়ির এই গৃহবধূ জিলিংসেলিং গ্রামে এই মুহূর্তে আত্মা। কারণ, উচ্চমাধ্যমিক পাশ মালতির হাত ধরেই এখন নিয়মিত প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে গ্রামের ১৩৫ জন শিশু। মালতির সঙ্গে এই স্কুল সমানভাবে চালাতে হাত লাগিয়েছে তাঁর স্বামী বাঙ্কা মূর্মূ এবং দেওর ভরত মূর্মূ। উচ্চমাধ্যমিক পাশ মালতি বিয়ের পর জিলিংসেলিং-এ এসে দেখেন এলাকার মানুষ শিক্ষার আলো থেকে কতটা দূরে পড়ে রয়েছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দ্বারা পরিচালিত কিছু প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র আশপাশের গ্রামে থাকলেও তাতে গ্রামের শিশুদের কোনও লাভ হচ্ছে না। কারণ, গ্রামের অধিকাংশ শিশু নিজের নামটাও ঠিক করে বলতে পারে না। এমনকী, বড়দেরও একই সমস্যা। নিজের সন্তানের নাম খেয়াল করতেও তাঁদের অনেকবার ভাবতে হয়। যার ফলে জিলিংসেলিং গ্রামের মানুষ ঠিক করে এলাকার বাইরের কোনও মানুষের সঙ্গে ঠিক করে কথাও বলতে ভয় পায়। প্রবল লজ্জায় হয় তারা মুখ নামিয়ে নেয়, নাহলে পুরো বেবাক বোবা বনে যায়। নিজেদের অভাব-অনাহার-অভিযোগ ঠিকভাবে মেলেই ধরতে পারে না মানুষগুলো। অথচ জিলিংসেলিং-এর মানুষ দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে দু-পেট খাবারের জন্য। মালতির মনে জিলিংসেলিং-এর শিক্ষার এই অভাব খুব জোরেই আঘাত করেছিল। মালতি-র মতে, তাঁদের গ্রামেও গরিবি রয়েছে, অনুন্নয়ন রয়েছে, কিন্তু জিলিংসেলিং-এর গ্রামবাসীদের মতো তাঁদের মুখের ভাষা হারিয়ে যায়নি। লকডাউনে পরিস্থিতি চরম আকার নিয়েছিল। প্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই স্বামী বাঙ্কা-র সঙ্গে পরামর্শ করে বাড়ির পিছনে টিলার উপরে স্কুল খোলে মালতি। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে স্বামী বাঙ্কা ও দেওর ভরত। বলতে গেলে অযোধ্যা পাহাড়ে এরাই এখন রাম-সীতা-লক্ষণ। আর রামায়ণের কাহিনির সঙ্গে জুড়ে থাকা অযোধ্যার নাম যেন এখানে সমার্থক হয়ে গিয়েছে। 

বাঙ্কা ও ভরত দুজনেই ঝালদা কলেজে স্নাতক স্তরের পড়ুয়া। বাঙ্কা এবং ভরত বহুদিন ধরেই এলাকায় নানা সমাজসেবামূলক কাজ নিজেদের উদ্যোগে করে আসছিল। এবার মালতির উদ্যোগে তারা যেন সঙ্গী পেল। ফলে মালতির স্কুল তৈরিতে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজেরাই বাঁশ কেটে খড় দিয়ে একটা ছাউনি মতো তৈরি করে। শহর থেকে নিয়ে আসা হয় ব্ল্যাকবোর্ড। টিলার উপরে ডানা মেলে মালতির স্কুল। অভাব-অনাহারের বিরুদ্ধে শিক্ষাই হোক আন্দোলন এই মন্ত্র জিলিংসেলিং-এর প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয় মালতি-বাঙ্কা-ভরত। কোনও ধরনের সরকারি সাহায্য ছাড়াই এবং রাজনৈতিক নেতাদের তেল না মেরেই জিলিংসেলিং-এ তাঁরা খাড়া করে ফেলে আস্ত একটি প্রাথমিক স্কুল।  

প্রত্যেকেরই পরনের জামা-কাপড়ের হতদরিদ্র অবস্থা, মহিলাদের পোশাক জুড়ে একাধিক জায়গায় সেঁলাই। কারোর পায়ে পরার চপ্পলটুকো পর্যন্ত নেই। তবু মালতি-বাঙ্কা ও ভরতের হাত ধরে শিক্ষার আলোয় এক নতুন আশায় এখন বুক বেঁধেছে জিলিংসেলিং। প্রথমদিকে স্কুলে ছেলে-মেয়েরা এলেও মাঝে মাঝে তা কমে যাচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বিধায়ক নেপাল মাহাতোর শরণাপন্ন হয়েছিল মালতি-বাঙ্কা-ভরতরা। বিধায়ক নেপাল মাহাতো স্কুলে আসা ছেলে-মেয়েদের জন্য ডিম-ছোলার বন্দোবস্ত করেন মানে মিড ডে মিল-এর। এরপর ফের ভরে উঠতে থাকে স্কুলে
ছেলে-মেয়েদর সংখ্যা। এই মুহূর্তে ১৩৫টি শিশুকে নিয়ে দৌঁড়চ্ছে মালতির স্কুল। 

জিলিংসেলিং-এর অভাব এবং অনাহারের জ্বালা এতটাই তীব্র যে এখানে নুন-ভাতকেই মানুষ পরমান্ন বলে মনে করে। সবজির দর ২০টাকা পার হলেই তা কিনে ঘরে আনাটাই কঠিন এখানকার বসবাসকারীদের পক্ষে। তখন আলু-ভাত আর নুন হয়ে দাঁড়ায় মূল খাদ্য। চালের দর আঠারো টাকা পার হলেই সমস্যায় পড়ে যায় মানুষ। মাংস! এখানে দিবাস্বপ্ন। মাঝেসাজে পরব বা উৎসবে বাড়িতে থাকা মুরগি-কে কেটে রান্না করা হলেও, অধিকাংশ সময়ে তা করতে চান না গ্রামবাসীরা। কারণ, মুরগি থেকে অন্তত ডিমটা সারাবছর মেলে। অযোধ্যার এক্কেবারে টিলার উপরে হওয়ায় জিলিংসেলিং-এ সেচের কাজ অকেজো। বর্ষা ছাড়া চাষবাস অসম্ভব এখানে। ফলে, পাহাড়ের নিচের গ্রামে যেখানে জলে মেলে চাষবাসে সেখানে জনমজুরি করা অথবা জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করা অথবা শহরে গিয়ে মজদুরি করা ছাড়া কোনও কর্মসংস্থানের রাস্তা নেই। এমনকী, জিলিংসেলিং-এর সামনে দিয়ে যে রাস্তা গিয়েছে সেখান থেকে দিয়ে কোনও পরিবহণ ব্যবস্থাও নেই। অগত্যা টিলা আর বড় বড় পাথর ডিঙিয়ে অন্তত ৭ থেকে ১০ কিলোমিটার হাঁটলে দেখা মেলে শহুরে জনপদের। নাহলে নিতান্ত ভরসা সাইকেল। 

এহেন এক অসহনীয় পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও লড়াই চালাচ্ছেন মালতি-বাঙ্কা-ভরতরা। তাঁদের মতে শিক্ষার আলো সঠিকভাবে পরিস্ফুট হলে মানুষ আরও সচেতন হবে। মানুষ নিজের উন্নতির প্রয়োজনিয়তাকে বুঝতে পারবে। জিলিংসেলিং-এর উন্নয়নের জন্য শুধু যে পাহাড়ের রসদ-ই যে শেষকথা নয়- তা মানুষ বুঝতে পারবে বলেই দাবি মালতিদের। আপাতত তাঁদের স্কুলে দুটি কক্ষ চালু করেছেন মালতিরা। সাহায্য পেলে ইচ্ছে আরও বড় করে স্কুলকে তৈরি করা। গ্রামে যাতে একটা মাধ্যমিক স্তরের স্কুল থাকে তারজন্য তদ্বিরও করছেন মালতিরা। 

২০২১ সালে পৌঁছে আজ ফের একবার বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে বয়ে চলে আসা মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা-জীবনের মানোন্নয়নের ইচ্ছেগুলো-কে কবে আমল দেবে রাজনৈতিক নেতারা- সে প্রশ্ন কিন্তু ছুঁড়ে দিয়েছে জিলিংসেলিং। এখনও এই গ্রামে এমনকিছু ঘর রয়েছে যারা ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে দিনের পর দিন অনাহারে থেকেছেন। এখনও অনেকে থাকছেন। একটা রাষ্ট্রের উন্নতি নির্ভর করে শিক্ষিত সমাজের উপরে। যেখানে ঘটা করে সরকারি প্রকল্পের উদ্বোধন হচ্ছে- তাহলে তার পুরো লাভ কেন পাচ্ছেন না দূরদূরান্তের মানুষ। কেন এখনও তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেল না শিক্ষার পর্যাপ্ত আলো- বিশুদ্ধ পানীয় জলের বন্দোবস্ত? এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। মানুষের কাজের তাড়নায় দল বদলে চলা নেতা-নেত্রী থেকে যারা দল বদল করেননি তাঁরা কি এর উত্তর দিতে পারবেন? 

Share this article
click me!

Latest Videos

Suvendu Adhikari Live : বিধানসভার বাইরে বিস্ফোরক শুভেন্দু অধিকারী, সরাসরি | Bangla News
'তৃণমূলের শান্তির ছেলেরা...মমতা-বিনীতকে জেলে ঢোকাবই' RG Kar কাণ্ডে বিস্ফোরক Suvendu Adhikari
এ যেন লুকোচুরি খেলা! ক্ষণে ক্ষণে স্থান পরিবর্তন, এখনও অধরা বাঘিনী যমুনা | Jhargram Tiger News
'কেন্দ্র যদি একটু দয়া দেখায় তাহলে হুগলিতেও মেট্রো চলবে', আশাবাদী Rachana Banerjee
'তৃণমূলের শান্তির ছেলেরা প্রমাণ লোপাট করেছে' | Suvendu Adhikari | #shorts #suvenduadhikari #rgkar