মাত্র ১ টাকায় রোগী দেখতেন তিনি। মনে করতেন রোগীর সেবাই পরম সেবা। দামি বেতনের চাকরির লোভ ত্যাগ করে পড়েছিলেন বোলপুরেই। অকাতরে সেবা করে গিয়েছেন মানুষের। ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের ছাত্র ছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্য়ায়।
প্রয়াত হলেন এক টাকার চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্য়ায়। বার্দ্ধক্য়জনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। কয়েক সপ্তাহ ধরেই দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার খবর নিয়ে প্রায় দিনই ফেসবুকে প্রচুর মানুষ পোস্ট করছিলেন। সেখান থেকেই জানা গিয়েছিল যে ১টাকা দিয়ে যিনি সারাটা জীবন রোগী দেখে এলেন সেই চিকিৎসক সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। মানুষের সেবার তাঁর অসামান্য মহানুভবতা এবং মহামানবের মতো পাশে দাঁড়ানোকে কুর্ণিশ জানায় দেশ। সুশোভন বন্দ্যোপাধ্য়ায়কে পদ্মশ্রী সম্মান দিয়ে সম্মানিত করেছিল ভারত সরকার।
ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই মানুষের পাশে থাকার শপথ নিয়েছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্য়ায়। ডক্টির বিধানচন্দ্র রায়ের অন্যতম প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। গুরু বিধানচন্দ্র রায়-এৎ আদর্শেই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন তিনি। আরজি কর কলেজে পড়ার সময় থেকেই তিনি সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছিলেন। ১৯৬৪ সালে বোলপুর থেকে বিধায়কও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আস্তে আস্তে রাজনীতির ফুলটাইম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং মানব সেবাকেই পরম সেবা বলে অন্তরাত্মাকে দীক্ষিত করেছিলেন।
১৯৬৩ সাল থেকেই তিনি প্রায় বিনামূল্যেই চিকিৎসা শুরু করেন। ৫৭ বছর ধরে অর্থের লোভকে পাশে সরিয়ে রেখেই তিনি রোগী দেখে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে তাঁর নামমাত্র ফিস বেড়া হয়েছিল মাত্র ১টাকা। তাও তিনি সেটা নিতেন রোগী স্বার্থের কথা ভেবে। কারণ বোলপুরে তাঁর ক্লিনিকে এমন বহু মানুষ আসতেন যাদের ওষুধ কেনারও অর্থ থাকত না। ১ টাকা করে ফিসের ওই টাকা গরীব রোগীদের খাতেই খরচ করতেন।
আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত ছাত্র ছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি থেকে প্যাথলজিতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রিও ছিল তাঁর। এরপর হেমাটোলজি নিয়ে ডিপ্লোমা করতে তিনি লন্ডনও চলে গিয়েছিলেন। চিকিৎসায় উচ্চ শিক্ষা লাভের পর তিনি ফের দেশে ফিরে এসেছিলেন। এই সময় ব্রিটেনের শেফিল্ডস-এ মোটা মাইনের চাকরিও ছেড়ে দেশে ফিরে আসাটাই তিনি শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। ৫৭ বছর ধরে প্রায় বিনামূল্যে রোগী দেখা শেষে তাঁকে ১ টাকার ডাক্তারের তকমা দিয়েছিল। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসও সুশোভনের রোগী দেখাকে বিশ্ব রেকর্ডের পাতায় স্থান করে দিয়েছিল।
ব্রিটেন থেকে ফিরে আসার পর কিছুদিন বিশ্বভারতীতে মেডিক্যাল অফিসারের চাকরি করেছিলেন। কিন্তু, মন মানেনি। বোলপুরের হরগৌরীতলাতেই চেম্বার খুলে বসে পড়েছিলেন মানুষের সেবা। যে সেবা করোনা অতিমারির মধ্যে অব্যাহত ছিল। স্ত্রী মণিমালা বন্দ্যোপাধ্য়ায় একজন গৃহবধূ। মেয়ে ও জামাই চিকিৎসক। বয়সের সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতাতেও নিয়ন্ত্রণ আসছিল। নিয়মিত ডায়ালিসিস চলতো। কিন্তু, কোনও দিনই রোগী দেখানো থামাননি। অসুস্থ হয়ে দুর্গাপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই মন খারাপ বোলপুরের হরগৌরীতলার। সময়ে-অসময়ে সকলেরই ভরসা ছিলেন সুশোভন বন্দ্যোপাধ্য়ায়। এই সময়ে আর কি মিলবে ১ টাকার এমন হৃদয়বান চিকিৎসক! শোকে মূহ্যমান বোলপুর।
আরও পড়ুন--
পাঁচিল ভাঙার বিরোধিতার 'মাশুল', বোলপুরে পদ্মশ্রী প্রাপকের মূর্তিতেও কালির আঁচড়
Padma Awards 2022: জেনে নিন কীভাবে পদ্ম পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয় এবং এর সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া
সুন্দরবনকে বাঁচাতে এক হাজার গাছ লাগালেন বিডিও বিধায়করা