স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, রাত ১০টা ৩০ মিনিটে বাসটি নয়ানঝুলিতে উল্টে যায়। এক বিকট আওয়াজ শুনে লোকজন বাইরে বেরিয়ে আসেন। তারাই তড়ডিঘড়ি উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। জানা গিয়েছে, বাসটি ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলা থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের তুলতে তুলতে রায়গঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। বাসটি লখনউ যাওয়ার কথা ছিল।
রায়গঞ্জে (Raiganj, North Dinajpur) রাতের অন্ধকারে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় জাতীয় সড়কের বেহাল দশাকেই দায়ী করছে উত্তর দিনাজপুরের জেলা প্রশাসন ( DM Office North Dinajpur)। আর সেই কারণেই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে (National Highway Authority of India) ক্ষোভ জানিয়েছেন উত্তর দিনাজপুরের জেলা শাসক (DM North Dinajpur)। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে উত্তরদিনাজপুরে চৌত্রিশ নম্বর জাতীয় সড়ক (34 No. National High Way) সম্প্রসারণের কাজ চলছে। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত সেই কাজের চল্লিশ শতাংশও শেষ করেনি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। এমনই অভিযোগ বারবারই উঠে এসেছে। বুধবার রাতে পরিযায়ী শ্রমিক ভর্তি বাস রায়গঞ্জের কাছে রূপাহারে নয়ানজুলিতে পড়ে যায়। রূপাহারের স্থানীয় বাসিন্দারাও দুর্ঘটনার রাতে জাতীয় সড়কের বেহাল দশাকেই দায়ী করেছিলেন। জেলা প্রশাসনও মনে করছে যে জাতীয় সড়কের বেহাল দশা বর্ষাকালে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এই কারেই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে বুধবার রাতেই ক্ষোভ উগড়ে দেন জেলাশাসক অরবিন্দ মীনা (DM Aravind Meena)। এদিকে, দুর্ঘটনায় ৬ জনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন জেলাশাসক। মৃতদের মধ্যে দুজন নাবালক রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
পুলিশ সূত্রে খবর যে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের মধ্যে দুজন শিশু। মৃতদের মধ্যে তিন জনের পরিচয়ও জানানো হয়েছে। এরা হল- বছর ২১-এর টোডো মূর্মূ। বাড়ি ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জের কালিদায়। বা়বার নাম গুরু মূর্মূ। বছর ২৬-এর লাখিরাম কর্মকার। বাবার নাম মোহন তুরি। বাড়ি ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জের বারা এলাকায়। তৃতীয় মৃত ব্যক্তির নাম হল মোনাসা টুডু। বয়স ২৩ বছর। বাবার নাম মোহন তুরি। বাড়়ি সাহেবগঞ্জের বারা এলাকায়। এদিকে, বৃহস্পতিবার সকালে নয়ানজুলির যে অংশে খাল গভীর আকার নিয়েছে সেখানে ডুবরি নামানো হয়। খালের ওই অংশে কেউ আটকে আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে ডুবরি। পুলিশ সূত্রে খবর এখন বাসের চালক বা কন্ডাক্টর অথবা খালাসি কারও কোনও সন্ধান মেলেনি।
উত্তর দিনাজপুরের জেলা শাসক অরবিন্দ মীনা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। ওই এলাকায় জাতীয় সড়কের হাল খারাপ ছিল। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে জরুরি ভিত্তিতে রাস্তা মেরামতের কথা বলা হয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাসটির চালক মদ্যপ অবস্থায় ছিল। ইটাহারে বাসটি একটি গাড়িতেও ধাক্কা মারে। এরপরই চালক বাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছিল। অত্যাধিক গতিতে চলতে থাকা বাসটি রূপাহারে জাতীয় সড়কের ডাইভারসানে এসে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি। টাল সামলাতে না পেরে রাস্তার পাশে থাকা নয়ানজুলিতে উল্টে যায়। পুলিশ সূত্রে আরও খবর যে মৃতদের অধিকাংশই বাসের বাঙ্কে শুয়েছিল।
রাত ১টা নাগাদ দুর্ঘটনাগ্রস্থ বাসটিকে (Raiganj Bus Accident) ক্রেন দিয়ে খাড়া করতে সমর্থ হয় পুলিশ (West Bengal Police)। আর বাস খাড়া হতেই আতঙ্কের মাত্রা যেন আরও বেড়ে যায়। কারণ, বাসের যে দিক নয়ানজুলির মধ্যে কাদায় ডুবে গিয়েছিল- সেই দিকে দেখা যায় একাধিক মৃতদেহ (Many Bodies Have been recovered)। হয় এগুলো বাসের বাইরে ঝুলছে না হয় অর্ধেক বাসের ভিতরে এবং অর্ধেক বাইরে বেরিয়ে রয়েছে। পুলিশ, দমকল (Fire Brigrade) এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (Disaster Management Force)এক এক করে দেহগুলিকে বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে আসে। অ্যাম্বুল্যান্সে করে দেহগুলি পাঠানো হয় রায়গঞ্জে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (Raiganj Medical College Hospital)। নয়ানজুলির কাদা এই মানুষগুলির প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তা প্রমাণ স্পষ্ট। কারণ প্রতিটি দেহ কাদায় এক্কেবারে মাখামাখি হয়েছিল। বিশেষ করে যে দেহগুলি বাসের জানলার পাশে বা বাসের বাইরে আটকে ছিল সেগুলির মাথা-মুখ এক্কেবারে কাদায়ে ভরে ছিল।
রাত ২টো পর্যন্ত পুলিশ সূত্রে বাস দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে ৪ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়। কোনও শিশু বা মহিলার মৃত্যর খবর জানানো হয়নি। বাসের চালক এবং কন্ডাক্টর ও খালাসিরা জীবীত না মৃত সেই তথ্যও জানায়নি পুলিশ। তবে বাসে সওয়ারি যাত্রীদের কাছ থেকে পাওয়া বয়ানে জানা গিয়েছে, বাসটি ৯৫ শতাংশ আসন ভর্তি ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে। এদের সকলেরই বাড়ি ঝাড়খণ্ডের পাকুর জেলা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা এবং উত্তর দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায়। বাসটি পাকুর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের তুলতে তুলতে মালদহ-রায়গঞ্জ হয়ে বিহারের দিকে যাচ্ছিল। সেখানেও আরও কিছু পরিযায়ী শ্রমিকদের বাসে তোলার কথা ছিল। আপাতত জানা গিয়েছে যে বাসটির গন্তব্যস্থল ছিল লখনউ। যদিও, বাসে থাকা কিছু পরিযায়ী শ্রমিক জানিয়েছেন তাঁরা দিল্লি যাচ্ছিলেন। এরা সকলেই উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় ও লাগোয়া অঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে কাজ করতেন। কিন্তু, করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ায় ও লকডাউন ঘোষণা হয়ে যাওয়া বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। পুজোর আগে উৎসবের মরসুমে কিছু রোজগারের আশায় এরা ফের পুরনো জায়গায় কাজে ফেরার জন্য বাসটিতে চেপেছিলেন।