কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে ভোট পরবর্তী হিংসায় পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে খুশি বিজেপি শিবির। তারা মনে করছে এতে এক্কেবারে এই বিপাকে পড়ে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে শুনানি ছিল। দুই শুনানিতেই আদালতের নির্দেশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের মুখোশ খুলে দিয়েছে বলে মনে করছে। বিজেপি শিবির থেকে মোট ১৪টি পয়েন্টের অবতারণা করা হয়েছে। তারা মনে করছে এই ১৪টি পয়েন্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে পিছনে ঠেলে দিয়েছে। এক নজরে এই ১৪টি পয়েন্ট।
১। বিজেপি-র দলীয় সূত্র থেকে দাবি করা হয়েছে, প্রথম থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ভোট পরবর্তী হিংসা-কে লঘু করে দেখানোর চেষ্টা করেছে। এমনকী তেমনভাবে কোনও হিংসার ঘটনা ঘটেনি বলেও নাকি রাজ্য সরকার থেকে দাবি করা হয়েছিল। কিন্তু, শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে রাজ্য সরকারের জবাবদিহি চেয়েছে তাতে আদালত স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে হিংসা হয়েছে ব্যাপকভাবে। রাজ্য সরকার যে হিংসার শিকার মানুষদের আস্থা অর্জনেও ব্যর্থ হয়েছে তা দুই আদালতের রায়েই স্পষ্ট বলে দাবি করেছে বিজেপি-র এই সূত্র।
২। বিজেপি সূত্রে আরও দাবি যে, ভোট পরবর্তী হিংসায় শুধু যে রক্ত ঝরেছে- মানুষ মরেছে- গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে-- এমনটা নয়, সেই সঙ্গে বহু স্থানে মহিলাদের উপরে তীব্র শারীরিক নির্যাতন হয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ শুক্রবার সেটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে বলে বিজেপি মনে করছে।
৩। ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে বিজেপি বারবার নাবালক ও নাবালিকাদের উপর অকথ্য অত্যাচারের বিষয়টিও সামনে নিয়ে এসেছিল। বীরভূমেই পাড়ুইয়ে ২ মে সাত বছরের এক শিশু সন্তানকে আছাড় মেরে ফেলার অভিযোগ এনেছিল বিজেপি। অভিযোগ ছিল ওই শিশুর কাকা এলাকায় বিজেপি-র প্রভাবশালী নেতা বলে পরিচিত ছিলেন। নির্বাচনের সময় তৃণমূলকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর সেই কারণেই কিছু দুষ্কৃতীর নৃশংস অত্যাচারের শিকার হয়েছিল শিশুটি। এই দুষ্কৃতীরা এলাকায় তৃণমূল নেতা এবং সদস্য বলে পরিচিত- এমন দাবিও করেছিল বিজেপি। শুক্রবার ভোট পরবর্তী হিংসায় কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছে তাতে নাবালক ও নাবালিকাদের উপরে বাংলায় অত্যাচার হওয়ার বিষয়টিও পরিস্কার হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রে দাবি করা হয়েছে।
এদিকে, বিজেপি-র পক্ষ থেকে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এদিন পরিস্কার বলেন যে আদালতের রায়ে রাজ্য সরকারের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। আদালত যেভাবে হিংসায় কবলিতদের দায়িত্ব নিতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে তাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের লজ্জা পাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন দিলীপ ঘোষ।
বিজেপি-র আইটি সেলের সর্বভারতীয় প্রধান অমিত মালব্য এই রায় নিয়ে টুইট করেন। তিনি টুইটে বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যে রিপোর্ট কলকাতা হাইকোর্টে জমা পড়েছে তাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপদার্থতা পরিস্কার ধরে পড়ে গিয়েছে।
ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন বিজেপি নেত্রী প্রিয়ঙ্কা টিবরিওয়াল। মামলা দায়ের সময় থেকেই তিনি হিংসা প্রতিরোধে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ এনেছিলেন। এদিন কলকাতা হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তাতে তিনি প্রবল খুশি। ফেসবুক লাইভ করে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসকে তুলোধনা করেন।
৪। বিজেপি সূত্রে আরও যে দাবি করা হয়েছে তাতে পরিষ্কার বলা হয়েছে, ভোট পরবর্তী হিংসা মোকাবিলায় রাজ্য সরকার যদি সফল হত তা হলে মানুষকে ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যেত হত না। তারা নিজ বাসভূমে থেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারত।
৫। মূলত কলকাতা হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ে আরও পরিস্কার হয়েছে যে ভোট পরবর্তী হিংসায় প্রচুর মানুষ তাদের ভিটে-মাটি থেকে যেমন উৎখাত হয়েছেন, তেমনি বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনটাও জানিয়েছে বিজেপি-র এই সূত্র।
৬। বিজেপি-র এই সূত্রের আরও দাবি যে, হিংসা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে বহু মানুষ বাংলা ছেড়ে ভিন রাজ্যে গিয়ে শরণার্থী হয়েছেন। এরা এখনও কেউ নিজেদের বাসভূমে ফিরে আসতে পারেননি।
৭। কলকাতা হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী রায়ে আরও পরিষ্কার হয়েছে যে এমন এক নৃশংস রাজনৈতিক সন্ত্রাসে সেভাবে কোনও গ্রেফতারির ঘটনাই ঘটেনি। এমনও দাবি করা হয়েছে বিজেপি-র এই সূত্রে।
৮। বিজেপি সূত্র থেকে আরও দাবি করা হয়েছে, আদালতের রায়ে সন্ত্রাসের ভয়াবহতা-র আরও একটি দিক উঠে এসেছে। আর সেটা হল যে শাসক বিরোধী মনোভাবাপন্ন মানুষের উপরে অত্যাচার এতটাই নির্মম ও নৃশংসতার সঙ্গে হয়েছে যে আতঙ্কে কেউ থানায় অভিযোগ দায়ের করতে যায়নি।
৯। বিজেপি সূত্রে আরও জানানো হয়েছে যে, যখন কলকাতা হাইকোর্ট থেকে নিযুক্ত জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ভোট পরবর্তী হিংসার তদন্তে নেমেছিল তখন অত্যাচারিতরা কিছুতেই সরাসরি কোনও অভিযোগ নথিভুক্ত করাতে চাইছিলেন না। এমনকী জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সামনে মুখও খুলতে চাননি। কিন্তু, যখন আইনি রক্ষা কবচ দিয়ে সেই মানুষগুলোকে একটা আস্থা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে তখন অভিযোগের পর অভিযোগ জমা পড়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন কলকাতা হাইকোর্টে জমা করা রিপোর্টে এমন কথাই জানিয়েছে। আর সেটা এদিনের রায়েই সামনে এসেছে বলে মনে করছে বিজেপি।
১০। কলকাতা হাইকোর্টের অন্তর্বর্তী রায়কে সামনে রেখে বিজেপি অভিযোগ করেছে, ভোট পরবর্তী হিংসার শিকার হওয়াদের মধ্যে অনেকেই আবার চিকিৎসা করানো নিয়ে সমস্যা পড়ছেন। এমন বহু তথ্য নাকি বিজেপি-র কাছে এসেছে, যেখানে দেখা গিয়েছে ভোট পরবর্তী রাজনৈতিক সন্ত্রাসে জখম হওয়া প্রচুর মানুষকে চিকিৎসাই করতে দেওয়া হয়নি।
১১। ভোট পরবর্তী হিংসা কতটা ভয়ঙ্কর- তা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে সারবত্তা পেয়েছে বলেই মনে .করছে বিজেপি। তাদের অভিযোগ, কলকাতা হাইকোর্টে জমা করা রিপোর্টে কমিশন সাফ জানিয়েছে-- যাদবপুরে হিংসার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে গিয়ে এবং নিগৃহীতদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যেভাবে কিছু মানুষ মারমুখী হয়ে তেড়ে এসেছে তা দেখে তারা হতবাক হয়ে যান। এমনকী সেখানে কোনও পুলিশকর্মী তাঁদের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েন ছিল না বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করেছে কমিশন। বিজেপি-র দাবি, এই ঘটনা বলে দিচ্ছে ভোট পরবর্তী হিংসা কতটা ভয়ঙ্কর।
১২। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার যে বিপাকে তার আরও প্রমাণ খোদ দুই পুলিশ কর্তাকে পাঠানো আদালতের শোকজ বলেও মন্তব্য করা হয়েছে বিজেপি-র এই সূত্রে।
১৩। হিংসা যদি না ঘটবে তাহলে সন্ত্রাসের শিকার হওয়াদের বিনামূল্যে রেশন সরবরাহের নির্দেশ আদালত দিত না বলেও মনে করছে বিজেপি।
১৪। ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে যে এখন ঢোক গিলতে হচ্ছে তার আরও বড় প্রমাণ আদালতের পাঠানো সমন। যা রাজ্যের মুখ্যসচিব-কে দিয়েছে আদালত এবং ভোট পরবর্তী হিংসা নিয়ে রাজ্যের জবাবদিহি তলব করা হয়েছে এই সমনে। বিজেপি-র মতে এটা প্রমাণ করে দিচ্ছে আদালতের সামনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপন্নতা।