দেশের ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রথমবার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল শবর অধ্যুষিত তেঁতলো গ্রামের বাসিন্দারা। কেন এতদিন স্বাধীন ভারতের তিরঙ্গা দেখতে পায়নি এই গ্রামবাসী এনিয়ে এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক তথা বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জগদীশ মাহাতো।
দেশের ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবসে (Republic Day 2022) প্রথমবার জাতীয় পতাকা উত্তোলন করল শবর অধ্যুষিত তেঁতলো গ্রামের বাসিন্দারা (Tetlo village in Purulia Jharkahand border )। এই গ্রামটি মূলত দলমা পাহাড়ের নিচে থাকা পুরুলিয়া ও ঝাড়খণ্ডের সীমানায় অবস্থিত। স্বাধীনতার ৭৫ বছর এবং গণতন্ত্রের ৭৩ বছরে পা দিয়ে এই প্রথম নিজে চোখে তিরঙ্গা ঝান্ডা দেখল গ্রামবাসী। এবং জাতীয় পতাকা উত্তোলনের (Flag hoist) পর জাতীয় সংগীত (National Anthem) গাইলেন তেঁতলো গ্রামের বাসিন্দারা। স্বাধীনতার এতগুলি বছর পেরিয়ে গিয়েও এই ঘটনা প্রকাশ্য়ে আসতেই স্বাভাবিকভাবে অবাক হওয়ার পালা প্রত্যেকেরই। স্বাধীন ভারতবর্ষের নাগরিক হিসেবে 'মৌলিক অধিকার' তাহলে হয়তো অনেক ভারী শব্দ শোনাতে পারে, যেখানে তিরঙ্গা দেখারও সৌভাগ্য পায়নি শবর অধ্যুষিত এই তেঁতলো গ্রাম। মাওবাদী অধ্যুষিত ওই এলাকায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এদিন দেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী ছিল এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কেন এতদিন স্বাধীন ভারতের তিরঙ্গা দেখতে পায়নি এই গ্রামবাসী, শুধুই কি অশিক্ষা নাকি লুকিয়ে রয়েছে অন্য কোনও বড় কারণ, এনিয়ে এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে (Asianet News Bangla) একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক তথা বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জগদীশ মাহাতো (Jagadish Mahato)।
'ভারতের জাতীয় পতাকা কী, আদতে এরা জানতই না'
বুধবার ৭৩তম প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনে প্ৰথম জাতীয় পতাকা উড়লো পুরুলিয়া-ঝাড়খণ্ড সীমানার ঝাড়খণ্ড রাজ্যের জামশেদপুর শিল্পাঞ্চল লাগোয়া সরাই কেলা- খরসোয়া জেলার নিমডি ব্লকের শবর অধ্যুষিত তেঁতলো গ্রামে। আদিবাসী যুব কল্যাণ সমিতি সদস্যরা এগিয়ে না এলে, এবারও হয়তো ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত এই গ্রামে প্রজাতন্ত্র দিবস পালন হয়ে না উঠতো না জাতীয় পতাকা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক তথা বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার জগদিশ মাহাতো জানান, 'মাওবাদী অধ্যুষিত প্রত্যন্ত তেঁতলো গ্রামে এবারই প্রথম জাতীয় পতাকা ওঠালাম। আমরা শিক্ষামূলক সমীক্ষা করার সময় শবর অধ্যুষিত তেঁতোলো গ্রামে গিয়ে জানতে পারি, এই গ্রামে কোনদিনও স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবস পালন হয়নি। ভারতের জাতীয় পতাকা কী, আদতে এরা এরা জানতই না। আজ ঝান্ডা উঠানোর পর জানলো এটাই আমাদের জাতীয় পতাকা।'
'কোনদিনও জাতীয় পতাকা উঠতে দেওয়া হয়নি', 'শবর জনজাতিকে মূলস্রোতে ফেরানো'
জগদীশ মাহাতো এশিয়ানেট নিউজ বাংলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে আরও জানান, 'এই গ্রামে শিক্ষার অভাব রয়েছে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি সেটা তো বিষয়। কিন্তু এর থেকেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল মাওবাদী ফতোয়া। তার কারণ দলমা পাহাড়ের নিচের এই এলাকা এখনো পুরোপুরি মাওবাদী অধ্যুষিত। এখনও রয়েছে মাওবাদী কার্যকলাপ। মূলত মাওবাদীদের হুমকি বা ফতোয়া যাই বলুন, যার জন্যই কোনদিনও জাতীয় পতাকা ওঠেনি বা উঠতে দেওয়া হয়নি। আমরাই প্রথম এবারে তেঁতলো গ্রামে জাতীয় পতাকা উঠিয়েছি। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই হোক বা এই সব গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছাতেই হোক, আমি আজ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সামিল ছিলাম । আমি চাই এসব এলাকায় শিক্ষা মূলক কাজ করতে যাতে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের শবর জনজাতিকে মূলস্রোতে ফেরানো যায়।' উল্লেখ্য, এদিন প্রজাতন্ত্র দিবস পালনের পর এলাকায় খাদ্য বিতরণ করা হয়।
'এখনও জলপাই রঙের পোশাকের আনাগোনা, ভারী বুটের আওয়াজ এবং বারুদে গন্ধ দলমার পাহাড়ের সর্বত্র'
বাংলার পুরুলিয়া জেলার একেবারেই সীমানায় ঝাড়খন্ড রাজ্যের নিমডি ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম তেঁতলো বরাবাজার ব্লক থেকে যার দূরত্ব ৩-৪ কিলোমিটারের বেশি নয়। বাংলার পুরুলিয়া জেলা মাওবাদী মুক্ত হলেও ঝাড়খণ্ডের সরাই কেলা খরসোঁয়া জেলায় দলমা পাহাড়-সহ বিস্তীর্ণ অংশ এখোনও মাওবাদী অধ্যুষিত। এখনও রয়েছে জলপাই রঙের পোশাকের আনাগোনা। এখনও ভারী বুটের আওয়াজ এবং বারুদের কটু গন্ধ স্পষ্ট রয়েছে দলমার পাহাড় থেকে জঙ্গল সর্বত্র। মাওবাদীদের প্রচ্ছন্ন হুমকি ফতোয়া এবং সাদা কাগজে লাল কালির পোস্টার দিয়ে মাওবাদী অস্তিত্ব জানান দেওয়া, যেনও নিত্য দিনের সাধারণ ঘটনা। স্বাধীনতা দিবস এবং প্রজাতন্ত্র দিবসের জাতীয় পতাকা উত্তোলন হতে না দিয়ে সেই জায়গায় কালো ঝান্ডা উড়িয়ে দেওয়াকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয় মাওবাদীরা। যার জন্য হয়তো তেঁতলোর মতো শবর অধ্যুষিত প্রত্যন্ত গ্রামের সাদাসিধে দীন দরিদ্র মানুষগুলি সাহস পাননি জাতীয় পতাকা ওড়ানোর। তবে বুধবার সত্যিই সূর্যের প্রথম কিরণ পৌছেছে এই গ্রামে। স্বাধীনতার স্বাদ এই হয়তো তাই এই প্রথম পেলেন শবর অধ্যুষিত তেঁতলো গ্রামের বাসিন্দারা। তাই এদিন যখন গ্রামে ৭৩ তম প্রজাতন্ত্র দিবসের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং সমবেত জাতীয় সংগীত গাইছেন গ্রামবাসীর, তখন তাঁদের মধ্যেও ছিল অজানা ভয়। যদিও এদিন জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়েই যেন ভয়কে জয় করলেন তেঁতোলা গ্রাম।