সংক্ষিপ্ত

  • দেবীপক্ষের সূচনায় একপক্ষ কাল আগেই সেজে উঠে কলকাতা
  • গত কয়েক দশক ধরে বিরাট আয়োজন করে পুজো উদ্যোক্তারা
  • করোনাকালেও কিন্তু পুজোর উদ্যোক্তারা করেছেন থিমের পুজো 
  • এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে সেই আয়োজন

খিদিরপুর ২৫ পল্লী

করোনাকালে কী দুর্গাপুজো করা আদৌ সম্ভব হবে? মাস তিনেক আগেও এ প্রশ্ন অনেকের মনে ঘোরাফেরা করেছে। তার আগে বাঙালির নববর্ষ পয়লা বৈশাখ, অন্নপূর্ণা পুজো, বাসন্তী পুজো এবং গণেশ চতুর্থী করোনার দাপটে একেবারে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। উৎসব প্রিয় বাঙালি তারপর থেকে ভাবনায় পড়েছিল যে আদৌ এবার বাংলায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের আয়োজন হবে কি না। ক্রমে বোঝা গেল পরিসর আগের মতো বিশাল না হলেও বাংলায় শারদোৎসব হচ্ছে। 

দেবীপক্ষের সূচনার একপক্ষ কাল আগেই সেজে উঠতে শুরু করল কলকাতার শারদোৎসবে যারা গত কয়েক দশক ধরে বিরাট আয়োজন করে আসছেন সেই সব সংঘ এবং উদ্যোক্তারা। কলকাতার দক্ষিণ থেকে উত্তর-বেশ কয়কটি জায়গায় এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলছে সেই আয়োজন। লক্ষ্যনীয় বিষয় হল এই করোনাকালেও কিন্তু পুজোর উদ্যোক্তারা থিমের পুজো করছেন। 

আরও পড়ুন- কবে থেকে কিভাবে শুরু হয়েছিল পুজোর নতুন বাংলা গান

শুরুতে কলকাতার ঐতিহ্যশালী পুজো খিদিরপুর ২৫ পল্লীর কথা বলা যায়। বরাবরই চমক দিয়ে এসেছে ২৫ পল্লী কমিটি। ৭৬তম বছরেও অন্যবারের মতো চমক দেখাতে তারা শুরু করেছিল গত বছর ডিসেম্বর মাস থেকে। তরুণ শিল্পী প্রদীপ্ত কর্মকারের থিম ভাবনা ছিল ‘বিশ্বাসে বিস্ময়ে’।সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে কিন্তু গত মার্চ মাস থেকে করোনায এবং লকডাউন। থিম বদল না হলেও বাজেট সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে আম্ফান-জোড়া বিপর্যয়ের সামনেও যুদ্ধ করেছে এই শহর আর অগুনতি মানুষ।সাহসে ভর করে এগিয়ে এসেছেন উৎসবের আঙিনায়, মাতৃ আরাধনার লক্ষ্যে। এই ইচ্ছাশক্তিকে খিদিরপুর ২৫-এর পল্লি এবার তুলে ধরছে তাদের থিম ‘বিশ্বাসে বিষ্ময়ে’।  

আরও পড়ুন- আগে পুজোতে নতুন জামার মতোই দেখা মিলত পুজোর নতুন সিনেমা

পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লি 

অতিমারীর দাপটে এক দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। করোনা সংক্রমণ আর তার জেরে আমাদের জীবনসংকট- এই ভাবনাযর কথা তুলে শিল্পী সন্দীপ মুখোপাধ্যায় সাজাচ্ছেন পাথুরিয়াঘাটা ৫-এর পল্লীর শারদোৎসব। তাঁর থিম- 'মরুতে রংয়ের ছটা'  উত্তর কলকাতার এই শারদোৎসব এবার ৮১তম বর্ষ। শিল্পীর কথা অনুযায়ী,  করোনা ভাইরাস সংক্রমণে এই পৃথিবী যেন এখন এক অশান্তির মরুভূমি। তাই দেবী আসুন, এসে আলোর দিশা দেখান গোটা মানবজাতিকে। সংক্রমিত রোগের কারণে রঙিন পৃথিবী এখন সাদা কালো। তাই তাঁর প্রয়াস পৃথিবীকে রঙে রাঙিয়ে তোলা।


সন্দীপ আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে মরুভূমি মানেই রাজস্থান। কিন্তু, সেই মরু রাজ্য ধূসর বা সাদা কালো নয়। নানা রঙের খেলা সেখানে লক্ষ্য করা যায়।  রাজস্থানী জীবন শৈলী, শিল্প, সংস্কৃতির ছবিকেই তুলে ধরা হচ্ছে মন্ডপে। প্রতিমাতেও থাকছে রাজস্থানী আর্টের ছোঁয়া। মরুভূমীর রঙের খেলাকে প্রাণবন্ত করতে অন্য ধরনের আলোর ব্যবহার ব্যবস্থা করেছেন সন্দীপ।পরিবেশকে জীবন্ত করে তুলতে রাখা হচ্ছে আবহসংগীত।করোনার কারণে পুজোর বাজেট ৫০ শতাংশ কমেছে। শুধুমাত্র মনের জোরে পুজো কমিটি ও শিল্পী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। সরকারি নির্দেশ মেনে ১০০ শতাংশ খোলামেলা রাখা হয়েছে মন্ডপ। থাকছে মাস্ক, স্যানিটাইজার সহ স্বাস্থ্যসুরক্ষা সমস্ত বন্দোবস্ত।

শিবমন্দির

দিন কয়েক আগেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্যের একাংশ চিকিৎসক চিঠি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন শারদ উৎসবের পর বাড়তে পারে করোনার সংক্রমণ। সেই সাবধানতা অবলম্বন করে 'নো মাস্ক নো এন্ট্রি'-র স্লোগান তুলেছে দক্ষিণ কলকাতার শিবমন্দির দূর্গাপুজো কমিটি। কলকাতার শারদোৎসবের ইতিহাসে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেছিলো ভবানীপুর ধর্মোৎসাহিনী সভা। অবশ্য এর প্রায় সমসাময়িক একাধিক পুজো শুরু হয়েছিল উত্তর কলকাতাতেও। কিন্তু যে সমস্ত পুজো কমিটির হাত ধরে দক্ষিণ কলকাতায় শারদোৎসবের পসার বৃদ্ধি হয়েছিল তাদের অন্যতম হল মুদিয়ালি এলাকার শিবমন্দির। এ বছর তাদের ৮৪তম বছর।

প্রতি বছর লক্ষাধিক মানুষের ভিড় হয় শিবমন্দিরের পুজো দেখতে। এই প্রথম শিবমন্দির পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা চাইছেন না দর্শকদের সমাগম। এ প্রসঙ্গে পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা পার্থ ঘোষ জানালেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে আমরা সবাই চিন্তিত। পুজোয় মাত্রাতিরিক্ত ভিড় হলে আমি আপনি কেন সারা পাড়া, গোটা জনপদ  সংক্রমিত হতে পারে। আমরা আগে ভিড় টানতে নানান স্লোগান ব্যবহার করতাম। কিন্তু এবার আমরা ঠিক করেছি একটু ভিন্ন ধরনের স্লোগান দেব। এবার আমরা বলছি, নো মাস্ক নো এন্ট্রি। কারণ মাস্ক না পড়ে এলে করোনা সংক্রমনের ভয় সবচেয়ে বেশি। মাস্ক পরে এলে শিবমন্দিরের ঠাকুর দেখতে পারবেন। মাস্ক না পড়ে না এলে ঠাকুর দেখতে পারবেন না’। 

শিল্পী সঞ্জীব ঘোষের ভাবনায় এবার এখানকার থিম-দেবী। শিল্পী সঞ্জীব জানালেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের দেবী একজন প্রতিবাদী। কিন্তু আমার কাছে সেই দেবী আরাধ্য। যাঁকে পুজো করে আমরা পরিত্রাণ পেতে চাই। যে বিশ্বাস থেকে আমরা তাঁর পুজো করি, সেই বিশ্বাসকেই আমি এখানে তুলে ধরছি’। সঞ্জীবের কথা অনুযায়ী,  গোটা বিশ্ব এখন মায়ের আঁচলের তলায় এসে মুক্তি পেতে চায়। এই অশান্ত সময়ে মায়ের আঁচলই একমাত্র মানবজাতির সাহারা। সেই প্রার্থনা স্থল থেকেই আলোর দিকে উৎসারিত হবে পথ।