Sukanta Majumdar On Mamata: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বাংলা সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় নিয়ে ফের সরব হলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার। কী বলেছেন তিনি? বিশদে জানতে পড়ুন সম্পূর্ণ প্রতিবেদন…
Sukanta Majumdar On Mamata: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী তথা অধ্যাপক সুকান্ত মজুমদার। বিশ্বকবির সাধের বাংলায় কীভাবে শিক্ষা-সংস্কৃতির অবক্ষয় হচ্ছে তা নিয়ে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। সুকান্ত মজুমদার বলেন, ''মমতার বাংলা: রবিচেতনার অবক্ষয়ের অকাট্য প্রমাণ। “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির…”
‘’এই পঙক্তিগুলো শুধুই কবিতা নয়, এ ছিল এক দর্শন, স্বপ্ন। এমন এক বাংলার স্বপ্ন, যেখানে মেধা হবে চালিকা শক্তি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে, সংস্কৃতির পীঠস্থান হবে এই বাংলা। রবীন্দ্রনাথ যে বাংলার কথা ভেবেছিলেন, তা ছিল আলোর পথিকৃৎ, প্রশ্ন করার সাহস যেখানে অপরাধ নয়, দায়িত্ব। আর আজ প্রশ্নহীন বুদ্ধিজীবীদের উপঢৌকন দিয়ে স্তাবক বানানো হচ্ছে, কাউকে জমি- বাড়ি তো কাউকে গাড়ি সহ পদ পাইয়ে দিয়ে, যা খুশি বলিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ছাব্বিশ হাজার শিক্ষকের চাকরি যাওয়ার জন্য দায়ী এই নির্লজ্জ স্বৈরাচারী সরকারকে কোনও কোনও কবি- লেখক মঞ্চে উঠে সমর্থন জানাচ্ছেন, এই দৃশ্য দেখলে মর্মাহত হতেন রবীন্দ্রনাথ।''
বিজেপি সাংসদ আরও বলেন, ‘’আজকের বাংলা যেন সত্যিই সব স্বপ্নের বিপ্রতীপে ক্রমক্ষয়িষ্ণু এক বাস্তব। ভয় আর চোখ রাঙানির রাজনীতিতে, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এখন শুধু মূর্তি আর ব্যানারে সীমাবদ্ধ। আর এই অবক্ষয়ের সবচেয়ে বড় দায় যাঁর, তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।''
তিনি জানান, এই বাংলায় শিল্পীর স্বাধীনতা আজ অলীক কল্পনা। সে স্বাধীনতা চায়ের কাপের তুফানেই সীমাবদ্ধ, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। প্রশ্ন করলেই, নৈরাজ্যবাদীর তকমা, ব্যঙ্গ করলে থানার নোটিশ। যে শিল্প একদিন ছিল প্রতিবাদের ভাষা, তা আজ পরিণত নির্লজ্জ স্তুতিতে। সিনেমা, নাটক, সাহিত্য, সব চালচোর- ত্রিপলচোরদের প্রচারের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। দ্য কেরালা স্টোরি, দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গলের মতো সিনেমা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একটি কার্টুন ফরওয়ার্ড করায় অম্বিকেশ মহাপাত্রের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা করে কারারুদ্ধ করা হয়েছে তাকে। বাঙালি সব ভুলে গেছে কি ? এসব কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এ এক অসহিষ্ণু শাসনব্যবস্থার অমোঘ প্রতিফলন। সেখানে, মতপ্রকাশ মানে অপরাধ। শিল্প শুধুই তুষ্টিকরণের মাধ্যম কিংবা নগ্ন জেহাদের প্রতি নীরব সমর্থন।
সুকান্ত আরও বলেন, ‘’সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, মুখ্যমন্ত্রী নিজের প্রতিকৃতি জুড়ে দেন রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষ ও রামকৃষ্ণের মতো মহামানব, বিশ্ব-বাঙালিদের পাশে। ধৃষ্টতার নির্মম উদাহরণ এ সব। বাঙালির গৌরবময় উত্তরাধিকার এ নয়, এ কেবল আত্মপ্রচার, আত্মমুগ্ধতার কৃত্রিম আলোয় নিজের ছায়া দীর্ঘ দেখানোর অপচেষ্টা। বাংলার যেসব নাম মানুষের মননে আলো জ্বালায়, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে তাঁদের সমকক্ষ ভাবা শুধু দুঃসাহস নয়, এক লজ্জাহীন স্বৈরাচারীর নগ্ন দম্ভ মাত্র। যাঁরা জীবন দিয়ে আদর্শ গড়েছেন, তাঁদের পাশে ছবি বসিয়ে কেউ ইতিহাসের অংশ হয় না। এ যেন ধার করা মহত্ত্বে মুখ গুঁজে নিজের কাল্ট তৈরির ধারাবাহিক কুচেষ্টা।''
এখানেই অবশ্য থেমে থাকেননি তিনি। “বাংলার মাটি, বাংলার জল” গানের “বাঙালি” শব্দ বদলে বসিয়ে দিলেন, “বাংলা”। একটা জাতির পরিচয়কে নিজের ব্র্যান্ডিংয়ের প্ল্যাটফর্ম বানাতে সেদিন তাঁর হৃদয় কাঁপেনি এক মুহূর্ত। কারণ, তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ কোনও মনীষী নন, বাঙালির আত্মার অস্তিত্ব নন। বরং গণতন্ত্রের উৎসব যে ভোটক তিনি বাজার বানিয়ে ছেড়েছেন, সেই পুতিগন্ধময় বাজারের এক ব্র্যান্ড। যিনি বাঙালির প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি, তাঁকেও নির্বাচনী হোর্ডিংয়ে ব্যবহার করে ফায়দা তোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেন তাই, মুখ্যমন্ত্রী।
সুকান্ত মজুমদার আরও বলেন, ‘’এই আত্মপ্রচার আর ইতিহাস বিকৃতির চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ২০২৫ সালের মার্চ মাসে, লন্ডনে। সেখানে দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ব্রিটিশ শাসন নাকি ভাল ছিল ! এমন কথা সেই রাজ্যের শাসকের মুখে, যে রাজ্যের কবিগুরু জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তস্নাত স্মৃতির প্রতিবাদে ইংরেজদের দেওয়া নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে ইতিহাসে নজির গড়েছিলেন। তিনি কবিতা লিখে, গান গেয়ে, নিজের সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের বুকের ভেতর বজ্রাঘাত করেছিলেন। আর আজ, সেই কবিগুরুর বাংলার শাসক লন্ডনে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের গুণগান করলেন। মাথা বিকিয়ে দিলেন সেই রক্তাক্ত অতীতের সামনে। এই হল তফাৎ। এক পাশে আত্মমর্যাদায় উজ্জ্বল রবীন্দ্রনাথের বাংলা, আর অন্য পাশে আত্মপ্রচারে মগ্ন আজকের শাসক। একজন কলমের আঁচড়ে জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, আর আরেকজন মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেই জাতিসত্তাকেই চিরনিদ্রার দেশে পাঠিয়ে দিতে চাইছেন।''
কবিগুরু যে শিক্ষা ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে ছিল মুক্ত চিন্তার আলো, ছিল সৃষ্টিশীলতায় প্রশ্রয়। আর আজকের বাংলায়? শিক্ষার নাম শুনলেই ভেসে ওঠে দুর্নীতির ছবি। এ শিক্ষা মানচিত্র বাঙালির নয়, এ এক সুপরিকল্পিত বাণিজ্য, যেখানে মেধা নির্বাসিত, আর অশিক্ষা, অর্থশিক্ষার রাজানুগত্যই হয়ে উঠেছে চাকরির চাবিকাঠি। শাসকের ঝুলিতে যত মোটা অঙ্ক, নিয়োগপথ তত মসৃণ। শিক্ষার মন্দির যেন পরিণত হয়েছে সওদাগরের হাটে, যেখানে ভবিষ্যৎ কেনাবেচা হয় নির্লজ্জ নিপুণতায়।
নারী স্বাধীনতা নিয়ে আজকের বাংলায় চলছে, দুর্বিষহ প্রহসন। কবিগুরুর সৃষ্টি, বিনোদিনী, চারুলতা, বিমলারা ছিলেন নিজ সিদ্ধান্তে পথ বেছে নেওয়া আলোর পথযাত্রী। তাঁদের চোখে ছিল প্রশ্ন, হৃদয়ে অনুভব, আর জীবনে ছিল নিজের জন্য বাঁচার সাহস। তাঁদের অস্তিত্ব কারও কন্যা, স্ত্রী বা জননী হয়ে নয়, পূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিভাসিত। কিন্তু আজ ? “রাত্রি সাথী” প্রকল্পের আড়ালে সরকার নিজেই স্বীকার করে নিচ্ছে, রাতের শহর নারীর জন্য নয়।
নারী হোক গৃহবন্দী, পর্দানসীন। প্রশাসনের পরোক্ষ স্বীকারোক্তি, নারী নিরাপত্তা আজকের বাংলায় আকাশকুসুম, তাই গৃহই হোক নারীর কারাগার। সেই গৃহও যে নিরাপদ নয় নারীর জন্য, সেখানে সে যে আক্রান্ত হতে পারে তার প্রমাণ দিয়ে গেল সাম্প্রতিক মুর্শিদাবাদ। কেবল শাঁখা সিঁদুর পরার জন্য অজস্র নারীকে অপমানিত হতে হল, তাঁদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হল, ইজ্জত কেড়ে নেবার হুমকি দেওয়া হল, কোলের বাচ্চা নিয়ে তাঁদের নদী পেরিয়ে আশ্রয় নিতে হল, পার্শ্ববর্তী মালদা জেলায়। এর আগে সন্দেশখালির হিন্দু পরিবারগুলিতে রাতে হানা দিয়ে শেখ শাহজাহান ও তার বাহিনীর মনোরঞ্জন করার জন্য গৃহবধূদের তুলে নিয়ে যাওয়ার লজ্জাজনক অধ্যায়ের কথা, আমরা সবাই জানি।
যেখানে একদিন নারী ছিল আলোর প্রতীক, সেই বাংলায় আজ তাঁকে আঁধারের ভয়ে ঘরে আটকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বিদ্রুপ বোধহয় এইই। আর সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হল, তারপরও তার রক্ষা নেই। হাসপাতালের ভিতর ডাক্তার, ঘরের ভিতরে নারী খুন ধর্ষণ হয়ে যেতে পারে, মমতার এই রাজত্বে।
তৃণমূল যখন “বাঙালি পরিচয়” রক্ষার বুলি আওড়ায়, তখন ইতিহাস লজ্জায় মুখ লুকায়। প্রশ্ন জাগে, কোথায় ছিল এই চেতনার মিথ্যা নাটক, যখন ফিরহাদ হাকিম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিলেন, “এই বাংলায় একদিন পঞ্চাশ শতাংশ বা তারও বেশি মানুষ উর্দু বলবে”? আর দাড়িভিটের সেই বিভীষিকা? দুই তরুণ রাজবংশী ছাত্র, রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মন বাংলা মাধ্যম স্কুলে উর্দু শিক্ষক নিয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল বলে তাদের বুক তাক করে চলেছিল গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল দুটি দেহ। ভেঙে গিয়েছিল একটি প্রজন্মের স্বপ্ন। আজও এই ঘটনার প্রসঙ্গ উঠলে প্রশাসন নিশ্চুপ, মুখ্যমন্ত্রী নিরুত্তর।
এ আর সেই বঙ্গ নয়, যে বাংলা একদিন গোটা উপমহাদেশকে দেখিয়েছিল নবজাগরণের দিশা। এ আর সেই বাংলা নয়, যেখানে কবিতা ছিল বিদ্রোহের ভাষা, আর কলম ছিল প্রতিবাদের অস্ত্র। আজকের বাংলা এক ক্লান্ত, ভীত, আর আত্মবিস্মৃত ভূখণ্ড, যেখানে সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে শাসকের সাজঘরের অলঙ্কার। এই বছর রবীন্দ্রজয়ন্তীতে শুধু মালা আর মঞ্চ নয়, আমাদের চাই শিকড় সন্ধান। দুঃসময়ে, শিকড় সন্ধানই উত্তরণের পথ দেখায়। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে, তাঁকে ফিরিয়ে আনতে হবে নামের বাইরে, ব্যানারের বাইরে, আনতে হবে চেতনার গভীরে। বাঁচাতে হবে সেই সমাজ, যা রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বা 'হিন্দু জমিদার' কুকথা শোনায় না, তাঁকে প্রাণের ঠাকুর বলে দেবত্বে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘’তাই আজ যা বলার তা হল, রবীন্দ্রনাথ যেন শুধু প্রণামের প্রতিমা না হন, হন প্রশ্ন তোলার প্রেরণা। যেন কেবল মিথ্যে উৎসবের মুখচ্ছবি না হন, হন বিবেকের আয়না। সেই রবীন্দ্রনাথকে আমাদের ফিরিয়ে আনতেই হবে। ফেরাতেই হবে তাঁর স্বপ্ন। মুক্ত মনন, আত্মানুসন্ধান আর আত্মদ্বন্দ্বের সংশ্লেষে উত্তরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন গুরুদেব। বাংলাকে সেই আলোকমুখী মার্গে ফেরাতে পারলে পরে তবেই আমাদের মুক্তি, নয়তো নয়।''
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে সুকান্ত মজুমদার আরও বলেন, ‘’বাংলার স্বপ্ন, বাঙালির স্বপ্ন আজও অসম্পূর্ণ। বাংলা ফের যেদিন রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করতে পারবে, ঘরে, সমাজে, আত্মায়, কেবল সেদিন আবার উচ্চ হবে এই বাংলার শির। নির্ভীক, বোধসম্পন্ন, জাগ্রত এক বাংলাকে ফিরে পাব আমরা। বাঁচাতে পারব খণ্ডিত বাংলার রবীন্দ্রময় ভুবন। সব স্বৈরাচার, সকল তালিবানির বিরুদ্ধে লড়ে যেতে পারব, রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এবং চেতনার জোরে। সেদিনই আমাদের সূর্যের ভোর। তার আগে নয়।''
আরও খবরের জন্য চোখ রাখুন এশিয়ানেট নিউজ বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে, ক্লিক করুন এখানে।


