তপন মল্লিক, প্রতিবেদক- সাধারণত সিনেমার গান বা আধুনিক গানের সুরকার বা যারা সেই সব গানের কথায় সুরারোপ করেন তারা নয় কন্ঠ সঙ্গীতের অথবা কোনও না কোনও বাদ্যযন্ত্রের অভিঙ্গতা থেকেই সেই কাজ করে থাকেন। কিন্তু সঙ্গীতের মতো বিশাল দুনিয়ার অআকখ না জেনেই যদি কেউ গানে সুর করে ফেলেন? শুধুমাত্র সুর করাই নয়, তার সুর করা একের পর এক গান যদি জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়ে ফেলে, আমরা সেই ঘটনাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো?
প্রথমেই বলি ঠিক এমনটাই কিন্তু ঘটেছিল। বিগত শতকের পাঁচের দশকের মাঝামাঝি সময় বোম্বাই সিনেমা দুনিয়ায় ‘কভি আর কভি পার’, ‘বাবুজি ধীরে চলনা’ প্রভৃতি গান যে হাঙ্গামা বাঁধিয়ে দিয়েছিল, শামসাদ বেগম থেকে শুরু করে গীতা দত্তের কন্ঠের মিহিদানাগুলি যে বলিউড থেকে টলিউড তোলপাড় করে দিয়েছিল তার অন্যতম কারণ গানের সুর। পরপর কয়েকটি ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পরার পর ১৯৫৪ সালে গুরু দত্তের ‘আর পার’ ছবিটি যে সারা ফেলেছিল তার একমাত্র কারণ ছবিটির সাতটি গান। সবকটিই হিট। সেই সুবাদে ছিবিটির পালেও লেগে গেল সাফল্যের বাতাস। হ্যা এটাই ঘটনা ‘আর পার’ ছবির সঙ্গিত পরিচালক, ছবির ওই সাতটি সুপার হিট গানের সুরকার যিনি গত শতকের পাঁচের দশকের মধ্য পর্ব থেকে গোটা ষাট দশক বলিউডের সিনেমা দুনিয়া রাজ করেছেন, সেই ওঙ্কারপ্রসাদ নাইয়ার বা ও পি নাইয়ার স্বরলিপি পড়তে পারতেন না, শোনা যায় তিনি হারমোনিয়ামও বাজাতে পারতেন না।
বোম্বাইতে তিনটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করলেন ঠিকই কিন্তু পরপর সেই ছবিগুলি যদি ব্যবসায়িক দিক থেকে মার খায় তাহলে কি ঘটতে পারে? অনিবার্যবশত পরপর তিনটি ফ্লপ ছবির পর সেই সঙ্গীত পরিচালক নিজের রাজ্য অমৃতসর ফিরে যাওয়ার জন্য ল্যাগেজ ঘুছিয়ে ফেললেন। পরের দিন তাঁর বকেয়া পারিশ্রমিক যা দিয়ে ফেরার টিকিট কাটতে হবে সেটা চাইতে কাচুমাচু মুখে প্রযোজক-পরিচালক গুরু দত্তের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু ‘বাজ’ ছবিটি মুখ থুবড়ে পরার পর আর কোনও টাকাপয়সাই গরু দত্তের হাতে ছিল না।
মাত্র তিন হাজার টাকার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করেছিলে নাইয়ার। কিন্তু গুরু দত্ত তখন সত্যি কপর্দকশুন্য। ফলত শুরু হল কথা কাটাকাটি। একটা পর্যায়ে গিয়ে সিদ্ধান্ত হল গুরু দত্তের পরের ছবিতেও সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে কাজ করবেন ও পি নাইয়ার। গুরু দত্তের মন থেকে একেবারেই সায় ছিল না কিন্তু নিরুপায় তিনি। এছাড়া সেদিন নাইয়ারের হাত থেকে বাঁচার আর কোনও রাস্তা ছিল না। বাধ্য হয়েই তিনি ঢোক গিলেছিলেন। সেই কথা মতো পরের ছবি ‘আর পার’-এর জন্য সঙ্গীত পরিচালকনির্বাচিত হলেন নাইয়ার এবং প্রযোজকের থেকে পেলেন দু হাজার টাকা। কিন্তু সে যাত্রায় আর তাঁর বাড়ি ফেরা হল না। উলটে বোম্বাইয়ে ঘাঁটি গেঁড়ে ফেললেন তিনি।এরপর গুরু দত্তের প্রযোজনায় রাজ খোসলার ‘সিআইডি’- ছবিতে শামসাদ বেগম, আশা ভোসলে ও মহঃ রফির গাওয়া ‘লেকে পহেলা পহেলা প্যার’, গীতা দত্ত ও মহঃ রফির গাওয়া ‘আঁখো হি আঁখো মে ইশারা হো গয়া’ প্রভৃতি গান নাইয়ারকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল যেখান থেকে সঙ্গীত পরিচালক ও পি নাইয়ারের শর্ত মেনে চলতে হত বোম্বাইয়ের প্রযোজকদের। বেশ কিছুকাল গুরু দত্তের সূত্রে গীতা দত্তই ছিলেন নাইয়ারের অন্যতম প্রিয় শিল্পী। কিন্তু পরবর্তীতে আশা ভোসলে সেই জায়গা দখল করে নেন।
‘নয়া দৌড়’ ছবির প্রযোজক তার ছবিতে প্লেব্যাকের জন্য মহিলা কন্ঠশিল্পী হিসাবে চেয়েছিলেন লতা মঙ্গেসকারকে। কিন্তু নাইয়ার জেদ ধরে বলেছিলেন আশাই গাইবে, তা না হলে তিনি কাজ করবেন না। অগত্যা তার জেদই প্রাধান্য পায় এবং ‘নয়া দৌড়’ ছবিতে রফি-আশার গাওয়া ‘মাঙ্গকে সাথ তুমহারা’, ‘উড়ে যব যব জুলফে তেরি’, ‘সাথী হায় বড়ানা সাথীরে’ গানগুলি এমন জনপ্রিয় হয় যে নাইয়ার বোম্বেতে একাই রাজ করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে ‘তুমসানেহি দেখা’, ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবির গানের সাফল্য তাকে বহুদিন বোম্বাইতে সবচেয়ে ব্যায়বহুল সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে রয়ে যান।
বোম্বাই সিনেমা দুনিয়ায় নাইয়ারের ঠাঁটবাটও ছিল আলোচনার বিষয়। শুধু তা কেন নাইয়ার ছিলেন অত্যন্ত মেজাজী মানুষ, তার কথার একটু এদিক ওদিক হলে তিনি চরম সিদ্ধান্ত নিতে দু’বার ভাবতেন না। একবার রফি রেকর্ডিং-এ দেরি করে আসায় তিনি রফিকে সে গান থেকে বাদ দিয়ে মহেন্দ্র কাপুরকে দিয়ে গাইয়েছিলেন। বেশ কিছুদিন রফি নাইয়ারের সুরে গান গাওয়ার সুযোগ পান নি। শুধু তাই নয়, হরি চৌরাশিয়া, রইস খানের মতো বাদ্যযন্ত্রীরা একসময় তার গানে বাজাতেন, তার কথার অন্যথা ঘটায় নাইয়ার তাঁদেরও রেকর্ডিং স্টুডিও থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লতাকে বাদ দিয়েই তিনি হিন্দি ছবিতে একের পর এক হিট গান হাজির করেছেন।যা ছিল আওব দিক থেকেই অবাস্তব কিন্তু সেটা তিনি সফলভাবেই সম্ভব করেছিলেন। এই আত্মবিশ্বাস ও অহমিকা তার শেষ দিন পর্যন্ত ছিল।