রাজনৈতিক জীবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। যে নন্দীগ্রাম তাঁকে রাজ্যের মন্ত্রী করছিল সেই নন্দীগ্রামেই তিনি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকেই তিনি জয়ী হয়েছিলেন। নিকটতম প্রতিদ্বন্দি সিপিআই-এর আব্দুল কবির শেখকে হারিয়েছিলেন ৫০ হাজারেও বেশি ভোটে। সেবার বিজেপি পেয়েছিল তৃতীয় স্থান। কিন্তু এবার বিজেপি বিজেপির প্রার্থী হয়ে ভোট যুদ্ধে সামিল হয়েছেন শুভেন্দু। তাঁর প্রতিপক্ষ তাঁর প্রাক্তন নেত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সংসদীয় রাজনীতিতে তিনি প্রায় অপরাজেয়। বহু বার ভোটে দাঁড়ালেও একবার ১৯৮৯ সালে সিপিএম প্রার্থী মালিনী ভট্টাচার্যের কাছে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। শুভেন্দু অধিকারীর কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ তিনি কী পারবেন মমতা মিথ ভেঙে ফেলতে?
'পিসির রাজ্যে গণতন্ত্রের চেহারা সামনে এল', নন্দীগ্রামে ভোটের আগেই মমতাকে নিশানা কৈলাসের ...
ডিসেম্বরেই দল বদল করে গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন ৫০ বছরের শুভেন্দু অধিকারী। প্রায় দুদশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজ্য রাজনীতিতেই গুরুত্বপূর্ণ নাম শুভেন্দু। পরিবার সূত্রের দুই মেদিনীপুরে রাজ করেছেন শুভেন্দু। একই সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদ , বীরভূমে প্রভাব বিস্তার করতে সামর্থ হয়েছিলেন নিজের সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে। সারদাকাণ্ডে মদন মিত্রর জেল হওয়ার পরেই শুভেন্দুকে পরিবহন দফতরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দলের সাংসগঠন দায়িত্বও বাড়ান হয়েছিল। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন অনুগামীও দল বদল করেন।
তৃণমূলে জমি আন্দোলন শুভেন্দু অধাকারীকে সর্বাধিক জনপ্রিয়তা দিয়েছিল। নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে তিনি প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তাঁর সাফল্যের পুরষ্কার হিসেবে শুভেন্দুকে প্রথমে ২০০৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের টিকিট দিয়েছিল তৃণমূল। সেবার তৃণমূলের অধিকাংশ প্রার্থী বামেদের কাছে পরাজিত হলেও শুভেন্দু জয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে তৃণমূলের টিকিটে তিনি লোসকভায় গিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার সদস্য হন।
মুকুল রায়ের পর তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিশালী সাংগঠক হিসেবে পরিচিতি ছিল শুভেন্দু অধিকারীর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বীরভূম, মালদা, মুর্শিদাবাদের মত গুরুত্বপূর্ণ জেলার সাংগঠনিক দায়িত্বও দিয়েছিলেন। একটা সময় পশ্চিমাঞ্চলের তৃণমূল সাংগঠনিক দায়িত্বও ছিল তাঁর ওপর। ছত্রধর মাহাত বা জনসাধারণের কমিটির সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগও রাখতেন তিনি। ধীরে ধীরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থা ভাজন নেতা হয়ে ওঠেন। দায়িত্ব পান যুব তৃণমূল কংগ্রেসের। কিন্তু সেই দায়িত্বের মধ্যেও কী নিহীত ছিল শুভেন্দুর বিক্ষুব্ধ তৃণমূলী হয়ে ওঠার অঙ্কুর?
কারণ শুভেন্দু অধিকারীকে সরিয়ে দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যুব তৃণমূল কংগ্রেসের দায়িত্ব দেন ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাজনৈতিক মহলের ধারনা তারপর থেকেই কালীঘাটের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে তাঁর। যদিও সারদাকাণ্ডে মদন মিত্র নাম জড়িয়ে যাওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পরিবহন দফতরের মত গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী করেন। তারপর সব ঠিকঠাক চললেও কালীঘাটের সঙ্গে ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ছিল কাঁথির অধিকারীদের। শুভেন্দু প্রকাশ না করলেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কারণে দূরত্ব-- বলেও দাবি করেন শুভেন্দু ঘনিষ্টরা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবকিছু সামাল দিতে শুভেন্দু অধিকারীকে একের পর এক জেলার সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়ে যান। মিতভাষী শুভেন্দুও তাঁর দায়িত্ব যে সঠিকভাবে পালন করে যাচ্ছিলেন তার প্রমাণ দেয় ভোটের ফলাফল। কিন্তু ওপর থেকে সবকিছু ঠিকঠাক দেখালেও সবকিছু যে ঠিক ছিল না তা আরও একবার প্রমাণ হয়ে যায় ডিসেম্বরে মমতার মন্ত্রিসভা থেকে শুভেন্দুর ইস্তফা।
সারদার কালির ছিটে না লাগলেও নারদকাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল শুভেন্দুর। যদিও গোটা ঘটনাটিকে ষড়যন্ত্র বলেই চিহ্নিত করেছেন তিনি। পাল্টা অভিষেককে নিশানা করতে তিনি কয়লাকাণ্ডকে হাতিয়ার করেছেন তিনি। একই সঙ্গে মোদী সরকারের প্রকল্পগুলিকেও তুলে ধরছেন তিনি। তাঁর প্রধানলক্ষ্য নন্দীগ্রামের হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কের দিকে। আর সেই কারণে যথেষ্ট পরিশ্রমও করছেন শুভেন্দু। যদিও দল ছাড়ার পর একাধিকবার অবোরোধ বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে শুভেন্দুকে তবুও হার মানতে নারাজ তিনি। ভোট প্রচারে নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য কিছুটা অস্বস্তিতে ফেললেও বাবা শিশির অধিকারীর পাল্টা মন্তব্যে শুভেন্দুর ক্ষেত্রে অনেকটাই ড্যামেট কন্ট্রোল করেছে বলেও মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে কথায় আছে যার শেষ ভালো তার সব ভালো- তাই নন্দীগ্রামের বাসিন্দারা কার পক্ষে রায় দেন সেটার এখন দেখার। যদিও বিজেপিও রীতিমত গুরুত্ব দিচ্ছে শুভেন্দু অধিকারীকে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁর হয়ে প্রচারে এসেছেন। তবে শেষ কথা বললেন নন্দীগ্রামের জনতা।