অখিলেশ মিশ্র- করোনা মহামারির দ্বিতীয় তরঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশ কিছু খারাপ সপ্তহ পরে অবশেষে আশার আলো দেখতে পাওয়া গেছে। প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা, গত সাত দিনের আক্রান্তের গ্রাফেরা পাশাপাশি সুস্থ হয়ে ওঠার একটি পরিসংখ্যা পাওয়া গেছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে সুস্থ হয়ে ওঠা করোনা রোগীর সংখ্যা।
তারই মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে- করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশাপি ভারতের সংবাদ মাধ্যমগুলিও এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এখানে।
১. টিকাকরণ
করোনাভাইরাসের টিকাকরণ ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা আর নীতি নির্ধারণের জন্য ১৪ এপ্রিল ২০২০ অর্থাৎ প্রায় এক বছর আগেই একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। তার মাত্র ৯ মাসের মাথায় ৬ জানুয়ারি থেকে গোটা দেশে টিকাকরণ চালু হয়েছে।
বর্তমানে জোর দেওয়া হয়েছে দেশীয় পদ্ধতিতে বিকাশ করা কোভ্যাক্সিনের উৎপাদন বৃদ্ধির। চলতি বছর জুন মাসের মধ্যেই কোভ্যাক্সিনের উৎপাদন দ্বিগুণ করা হবে। পরবর্তী সময় ৬-৭ গুণ করার চিন্তাভাবনা।
২০২১ সালের জুলাই অগাস্ট মাসের মধ্যে ৬০-৭০ লক্ষ ভ্যাকসিনের ডোজ উৎপাদন করা হবে। আর সেপ্টেম্বরে তা বাড়িয়ে করা ১০০ মিলিয়ন ডোজ করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের জানিয়েছে বছর শেষে ভারতের হাতে ২.১৬ মিলিয়ন ভ্যাকসিনের ডোজ থাকবে।
২. অক্সিজেনের যোগান
করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গের আগে থেকেই দেশে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছিল। আগে প্রতিদিন দেশে ৯০০ মেট্রিকটন অক্সিজেনের প্রয়োজন হত। এখন অক্সিজেনের চাহিদা ৯ হাজার মেট্রিকটন। বেশ কয়েক দিন চাহিজা অনুযায়ী যোগান না থাকায় সমস্যায় পড়তে হয়েছিল দেশের মানুষদের। বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বিদেশ থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসার পাসাপাশি দেশেও তরল মেডিক্যাল অক্সিজেনের উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
৩. ওষুধসহ করোনা চিকিৎসার সামগ্রী
করোনাভাইরাসের আক্রান্তদের চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ রেমডেসিভিরের উৎপাদন বাড়ান হয়েছে। এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত ১০.১ মিলিয়ন ওষুধ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে টোকিলিজুমাবও সংগ্রহের ওপর জোর দিয়েছে কেন্দ্র। দেশের মানুষের প্রয়োজনে ভারতের ড্রাগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিআরডিও-র তৈরি করা করোনা-ওষুধও জরুরি ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। সরবরাহ করা হয়েছে ১৬,১৯ মিলিয়ন পিপিই কিট, ৪১ মিলিয়ন এন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করা হয়েছে স্বাস্থ্য কর্মী ও ফ্রন্টলাইন করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে। ৩৮ হাজার ১০৩টি ভেন্টিলেটর সরবরাহ করা হয়েছে।
৪. পরীক্ষা কাঠামো
করোনাকালে কোভিডেন নমুনা পরীক্ষার ওপরেও জোর দেওয়া হয়েছে। ২৪৬৩টি পরীক্ষাগারে প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকেই পরীক্ষাগারের কাঠামোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
৫. হাসপাতাল ও পরিষেবা
গোটা দেশেই একাধিক হাসপাতালকে কোভিড হাসপাতালে উন্নীত করা হয়েছে। আর যেখানে তা সম্ভব হয়নি সেখানে কোভিড ওয়ার্ডা চালু করা হয়েছে। ১.৮৬ মিলিয়ন শয্যা কোভিড হাসপাতালগুলির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। গতবছর লকডাউনের আগেও দেশে মাত্র ১০,১৮০টি আইসোলেশন শয্যা ছিল। পাল্লা দিয়ে বাড়ান হয়েছে আইসিইউ বেড। বর্তামানে এই বেডের সংখ্যা ৯২ হাজার। করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য রেলওয়ে কোচেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৬. নাগরিক সহায়ত
করোনাকালে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতেও উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। গম বিক্রির জন্য তিন বিলিয়ন টাকা পঞ্জাবের কৃষকদের ব্যাঙ্কা অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে। এই প্রথম পঞ্জাবের কৃষকরা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে তাঁদের প্রাপ্য টাকা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার অধীনে ১ লক্ষ মেট্রেকটন খাদ্য শশ্য বিলি হয়েছে। উপকৃত হয়েছে ১২টি রাজ্যের ২০ লক্ষ মানুষ। গত বছর এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে ৮০ লক্ষ মানুষ উপকৃত হয়েছিলেন।
৭. বিশ্ব সহায়তা
গোটা বিশ্বের দিকে করোনামহামারি মোকাবিলায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারত। আর দ্বিতীয় তরঙ্গের সময় ভারতের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল বিশ্বের একাধিক দেশ। তাদের পাঠান ৮৯০০ অক্সিজেন কনসেনটেনর, ৫ হাজারেও বেশি অক্সিজেন সিলিন্ডার, তিরিশ লক্ষের বেশি রেমডেসিভির সরবরাহ করা হয়েছে বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে।
৮. রাজ্য ও স্থানীয় প্রশাসনকে আর্থক সাহায্য
২৫টি রাজ্যের পঞ্চায়েত এলাকার মানুষদের সহযোগিতার জন্য ১.৫ বিলিয়ন টাকা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা মূলত কোভিড জরুরি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্যই খরচ করা হবে। একাধিক রাজ্যকে ঋণও দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
৯. ওষুধের চাহিদা মেটাকে আর্থিক সাহায্য
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার লিকুইড ক্যাস হিসেবে দেওয়া হয়েছে। জরুরি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের কোভিড সম্পর্কিত পরিকাঠামো তৈরির জন্য় রোপো হার তিন বছর পর্যন্ত একই রাখা হয়েছে। এমএসএমই ও অন্যান্য অসংগঠিত খাতে ২.৫ বিলিয়ন ডরাল বরাদ্দ করা হয়েছে। নাম মাত্র সুদের বিনিয়ম ঋণ দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
১০. পিএম কেয়ার ফান্ড
করোনামোকাবিলায় তৈরি হয়েছিল পিএমকেয়ার্স ফান্ড। এই ফান্ডের টাকা থেকে ১২০০ টি মেডিক্যাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট শুরু করা হয়্ছে। ১৫০,০০০ অক্সিজেন কনসেনটেনর কেনা হয়েছে। ৫০ হাজার ভেন্টিলেটর কেনার কাজেও এই টাকা খরচ করা হয়েছে। এই ভেন্টিলেটরগুলি দেশেই তৈরি হচ্ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের ত্রাণের জন্য ১৫০ মিলিয়ন খরচ করা হয়েছে। এি ফান্ডের টাকা থেকেই কেনা হচ্ছে ভ্যাকসিন ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী।
১১. সামনে থেকে নেতৃত্ব প্রদান
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কোভিড মোকাবিলায় প্রথম থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দফায় দফায় বৈঠক করছেন। দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এখনও পর্যন্ত জাতির উদ্দেশ্যে ১০ বার ভাষণ দিয়েছেন তিনি। করোনা মোকাবিলায় নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ জানিয়েছেন দেশের মানুষকে। এছাড়াও একাধিক অনুষ্ঠানও করেছেন। প্রথম তরঙ্গের সময় যেমন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন দ্বিতীয় তরঙ্গের সময়ও তাই করছেন। কথা বলেছেন ওষুধ, অক্সিজেন নির্মাতাগের সঙ্গে। ঘুরে দেখেছেন টিকা তৈরির কারখানাগুলিও।
*লেখক নয়াদিল্লির পাবলিক পলিসি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ব্লুক্রাফ্ট ডিজিটাল ফাউন্ডেশনের সিইও এবং এর আগে মাইগভ এর কনটেন্ট বিভাগের ডিরেক্টর ছিলেন।