সরস্বতী পুজোর আগে মুক্তি পেয়েছে রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ছবি দিলখুশ। নতুন বছরের শুরুতেই বক্স অফিসে দুর্দান্ত সাফল্য পাওয়ার সবরকম মশলা আছে এই ছবিতে।
ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মায়ের বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে। মায়ের কথায়, 'তোর বাবা ছিল একটা জানোয়ার'। মা-মেয়ে দু'জনকেই নিয়মিত ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হয়। মেয়ে অবশ্য মনখারাপ হলেই খায় দিলখুশ। ছোটবেলায় মা কিনে দিত। সেটাই অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই মেয়ে তৈরি করেছিল একটি ডেটিং অ্যাপ। কিন্তু অন্য একজন সেই অ্যাপ নিজের নামে চালাচ্ছে। মেয়েটির প্রেমিক সম্পর্ক রাখতে চায়নি। সবমিলিয়ে চূড়ান্ত অবসাদগ্রস্ত মেয়েটি। সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৪ ফেব্রুয়ারি নিজের তৈরি ডেটিং অ্যাপই হ্যাক করে। সে জানত না, এর ফলে আরও অনেকের তো বটেই, তার মায়ের জীবনও বদলে যাবে। এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা যেমন জটিলতা তৈরি করে, আবার অনেক সমস্যার সমাধানও করে দেয়। সবচেয়ে বড় কথা, কয়েকজনকে বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। এটাই রাহুল মুখোপাধ্যায়ের ছবি দিলখুশের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট। সিনেমার মতো প্রেম নয়, বরং বাস্তবের প্রেমের গল্পই পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন রাহুল। সব স্তরের মানুষ এই ছবিতে নিজের জীবনের কোনও না কোনও ঘটনার সঙ্গে মিল খুঁজে পেতে পারেন। দিলখুশ' ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে কয়েকজন আলাদা মানুষকে নিয়ে। বয়স, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান, মানসিকতা, সবদিক থেকেই আলাদা এই মানুষরা। কিন্তু তারপরেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
ছবির কাহিনি
এক বৃদ্ধ কানে খাটো। ভালো হিয়ারিং এইড কেনার মতো অর্থ নেই। তিনি শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট লেখেন। ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁর জীবনে কোনও নারীর আবির্ভাব হয়নি। কিন্তু হঠাৎ একদিন ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে আলাপ হয় কাছাকাছি বয়সের এক বৃদ্ধার সঙ্গে। এই বৃদ্ধা থাকেন লেডিজ হস্টেলে। ছেলে থাকে বিদেশে। বয়স হলেও মন এখনও রঙিন। তিনিই শ্মশানে ডেথ সার্টিফিকেট লেখা বৃদ্ধের জীবনেও রঙের ছটা এনে দেন। একটি মেয়ে ছোটবেলায় মাকে ইয়ট থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করতে দেখেছে। কারণ, ব্যবসায়ী বাবা তাঁর ডিলারদের সঙ্গে স্ত্রীকে শারীরিক সম্পর্কের জন্য জোর করতেন। মাকে ছাড়া বড় হওয়া মেয়েটি ইন্টারনেটে নিজের শরীর দেখায়। ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয় পেশায় সিকিউরিটি গার্ড এক যুবকের সঙ্গে। এই যুবকের স্ত্রী আবার তাঁরই সবচেয়ে কাছের বন্ধুর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছে। মেয়েটি একদিন ওই যুবকের সঙ্গেই পালিয়ে যায়। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারানো একটি তথাকথিত ক্যাবলা ছেলে গিনিপিগ নিয়ে গবেষণা করছে। যে প্রেমিকার সঙ্গে সে আর সম্পর্ক রাখে না, তারই তৈরি ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে আলাপ হয় এক অভিনেত্রীর মেয়ের সঙ্গে। এই অভিনেত্রী আবার এক যাত্রার খলনায়কের প্রাক্তন স্ত্রী। এই খলনায়কের সঙ্গেই যে মেয়েটি ডেটিং অ্যাপ তৈরি করেছে তার মায়ের সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সবার জীবনের গল্প আলাদা, কিন্তু তাঁদের মিলিয়ে দিয়েছে ডেটিং অ্যাপ 'দিলখুশ'।
অভিনয়
এই ছবির পরিচালক রাহুলের সুবিধা হয়েছে তিনি কয়েকজন জাত অভিনেতাকে পেয়ে গিয়েছেন। খরাজ মুখোপাধ্যায়, অপরাজিতা আঢ্য, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনসূয়া মুখোপাধ্যায় বরাবরের মতোই সাবলীল অভিনয় করেছেন। তাঁদের হাসি-কান্না, অভিব্যক্তি, সংলাপ দর্শকদের নাড়িয়ে দিয়েছে। মধুমিতা সরকার, সোহম মজুমদার, ঐশ্বর্য সেন, অনন্যা সেন, উজান চট্টোপাধ্যায়ও বেশ ভালো অভিনয় করেছেন। ছবির প্রথমার্ধে শুধুই হেসেছেন দর্শকরা। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে অনেকরকম আবেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছে।
গান-সুর-কথা
এই ছবির গান 'সজনী তোকে ভালোবাসব', 'তবু অন্য কোথাও', আপাতত যাই' বেশ ভালো। সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন নীলায়ন চট্টোপাধ্যায়। সব গানই শোনার মতো।
চিত্রনাট্য
'দিলখুশ'-এর অন্যতম সম্পদ অরিত্র সেনগুপ্তর চিত্রনাট্য ও সংলাপ। চিত্রনাট্য মেদবর্জিত। সাধারণ মানুষ ঠিক যে ভাষায় কথা বলেন, সেটাই উঠে এসেছে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে। পরাণ, অনসূয়া, অপরাজিতা, খরাজ সংলাপের মাধ্যমে দর্শকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এমনকী সংলাপ শুনে মাল্টিপ্লেক্সেও সিটি শোনা গিয়েছে। অপরাজিতার বিভিন্ন সংলাপে হাসির রোল দর্শকদের মধ্যে।
ফোটোগ্রাফি
কলকাতার বিভিন্ন রাস্তা, গড়ের মাঠ, রবীন্দ্র সরোবর, রবীন্দ্র সদন, ডুয়ার্স উঠে এসেছে এই ছবিতে। মধুরা পালিতের সিনেমাটোগ্রাফি বেশ ভালো। ডুয়ার্সে মধুমিতা-সোহমের পালানো, খুনসুটি, হাসি-কান্না দারুণভাবে ধরা পড়েছে লেন্সে।
এডিটিং
'দিলখুশ' সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন শর্মিষ্ঠা চক্রবর্তী। তাঁর কাজ বেশ ভালো হয়েছে। পরবর্তীকালে আরও ভালো কাজ করতে পারেন তিনি।
পরিচালনা
রাহুলের দ্বিতীয় ছবি 'দিলখুশ'। 'কিশমিশ'-এর পর দর্শকদের আরও একটি মিষ্টি ছবি উপহার দিলেন তিনি। পরিচালক হিসেবে বেশ পরিণত হয়েছেন রাহুল। পরিমিতভাবে বিভিন্ন আবেগ পর্দায় ফুটিয়ে তোলা রপ্ত করে নিয়েছেন তিনি।
উপসংহার
প্রেম যে বয়স, সামাজিক ব্যবধান, আর্থিক বাধা মানে না, সেটাই দেখিয়েছে 'দিলখুশ'। এই ছবিতে নানা স্তর রয়েছে। মা-মেয়ে, মা-ছেলের সম্পর্ক, বেশি বয়সে প্রেমে ছেলে-মেয়ের বাধা, অশান্তি যেমন আছে, তেমনই আবার ভুল বোঝাবুঝি মিটেও গিয়েছে। জীবনে সমস্যা থাকলেও, ভালোবাসার মাধ্যমে যে সমস্যা মিটিয়ে নেওয়া যায়, সেটাই তুলে ধরেছে এই ছবি।
কত রেটিং পেল?
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার বিচারে ৫-এর মধ্যে 'দিলখুশ' ৩.৫ পাচ্ছে।