স্রাবের কারণে নারীরা মানসিকভাবে হতাশায় ভেঙে পড়েছেন এমন কাহিনির শেষ নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামান্য অজ্ঞানতার কারণে স্রাব প্রচুর বিপদ ঢেকে আনে। তবে, স্রাবের জন্য নারী শরীর যত না বিপদে পড়ে, তার থেকে বেশি বিপদ তৈরি হয় লজ্জার জেরে। অধিকাংশ নারী এই নিয়ে তথ্য-আদান প্রদানে অপরাগ।
সাদা স্রাব নিয়ে অধিকাংশ মহিলাদের ধারণাটাই স্পষ্ট নয়। এই নিয়ে ভারতীয় নারীদের মধ্যে প্রবলভাবে কিন্তু কিন্তু কাজ করে। এমনকী, বহুক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে শিক্ষিত মহিলারাও এই নিয়ে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। যার ফলে অনেক সময় সাদা স্রাব নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। কেউ মানসিক হতাশায় ভোগেন। কেউ আবার সাদা স্রাবের ভালো-মন্দটা ধরতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেক সময় তা প্রাণঘাতীও হয়ে যায়। কিন্তু সাদা স্রাব কেন আসে? কোন ধরনের স্রাব শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক তা নিয়ে একটা সম্যক ধারণা মহিলাদের মধ্যে থাকলে এই নিয়ে অহেতুক চিন্তা শুধু কমবে না, সেই সঙ্গে মহিলারাই নিজের গোপন স্বাস্থ্যের তদারকিটা নিজেরাই ভালোভাবে করতে পারবেন।
সাদ স্রাব স্বাভাবিকও হয়, আবার এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শও নিতে হতে পারে। তবে আগেভাগে চিকিৎসকের কাছে না দৌঁড়ে বুঝে নেওয়া দরকার একজন মহিলার শরীরে যে সাদা স্রাব বের হচ্ছে তা আদৌ চিন্তাজনক কিনা। এই কারণ চিকিৎসকরা সাদা স্রাব-কে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন- একটি স্বাভাবিক এবং অন্যটি অস্বাভাবিক। প্রথমে আলোচনা করা যাক- স্বাভাবিক সাদা স্রাব নিয়ে।
স্বাভাবিক সাদা স্রাব- ৪ ধরনের
স্বাভাবিক সাদ স্রাব নিয়ে এখানে যে আলোচনা করা হচ্ছে সেখানে ৪ ধরনের স্রাবের কথা বলা হচ্ছে। এগুলো যদি একজন নারীর শরীরে নিঃসরণ হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে এই সাদা স্রাব একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই। এই স্বাভাবিক সাদা স্রাবের মধ্যে একটি ধরণ হচ্ছে তা দই-এর মতো ঘন হবে এবং রঙ হবে সাদা। আর এক ধরণের সাদা স্রাব রয়েছে যার রঙ সাদা হলেও এটা একটু পাতলা হয়। এছাড়াও স্বাভাবিক সাদা স্রাব দুধ বা জলের মতো পাতলা হতে পারে। এর বাইরে আর এক ধরণের সাদা স্রাব রয়েছে যা দেখতে স্বচ্ছ এবং অনেকটা কাচা ডিম ভেঙে ফেললে ভিতর থেকে জেলির মতো তরল বেরিয়ে আসে তার মতো। একটু আঠালো হয়। আঙুল দিয়ে চেপে ধরলে তা একে অপরের সঙ্গে লেগে থাকে। চিকিৎসকদের মতে এই ৪ ধরণের সাদা স্রাব এক্কেবারেই স্বাভাবিকতার লক্ষণ। এই নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করার কিছু নেই।
স্বাভাবিক সাদা স্রাব কতটা পরিমাণে নিঃসরণ হয়
স্বাভাবিক সাদা স্রাব একদিনে ২ থেকে ৫ মিলিমিটারের মতো নিঃসরণ হয়। অনেক সময় অনেকের অন্তর্বাস একটু বেশি ভিজে থাকলে চিন্তা শুরু করে দেন। এক্ষেত্রে বলার যে এই নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। কারণ, একেক মাসে একেক পরিমাণ সাদা স্রাব নিঃসরণ হয়। কখনও কম হতে পারে, আবার কখনও বেশি, তবে ৫ মিলিমিটারের সামান্য বেশি হলেও চিন্তা করবেন না। আর নিজের সাদা স্রাব নিঃসরণের সঙ্গে অন্যের সাদা স্রাব নিঃসরণের তুলনা করবেন না। এটা মানুষ ভেদে একেক জনের ক্ষেত্রে একেকরকম হয়। সাদা স্রাবে একটু নজর রাখলেই একজন নারী তাঁর শরীর থেকে নিঃসরণের ধাঁচটা বুঝতে পারবেন এবং তিনি যথাযথভাবে তা নজরে রাখতে পারবেন।
সাদা স্রাব কি শরীরের ক্ষতি করে
চিকিৎসকদের মতে সাদা স্রাব নিঃসরণ যোনীর জন্য ভালো। কারণ, এর ফলে যৌনির মাসিকের পথ পরিস্কার হয় এবং তার স্বাস্থ্যবিধি বজায় থাকে। এটা একটা শারীরিক প্রতিক্রিয়া। আর অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই সাদা স্রাব থাকে। সাদা স্রাব কোনওভাবেই একজনকে দূর্বল করে দেয় না অথবা স্বাস্থ্য ভেঙে দেয় না। কারও যদি এই ধরনের অসুবিধা থেকে থাকে তাহলে সেটা হয় সাদা স্রাব নিয়ে মানসিক চিন্তা থেকে।
এমনকিছু স্রাব যা রোগের লক্ষণ
চাকা চাকা স্রাব- দই বা পনিরের মতো থকথকে হয়ে থাকে এই স্রাব। এর মধ্যে আটার দলার মতো ছোট ছোট পাকানো গুলির মতো জিনিস দেখতে পাওয়া যায়। এই ধরনের স্রাব শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক। এতে অনেকের যোনিতে চুলকানি হয়। প্রস্রাব বা সহবাসের সময় যোনিতে ব্যাথাও লাগে। একে অনেক সময় চিকিৎসকরা ইস্ট ইনফেকশনও বলে থাকেন। এই ধরণের সাদা স্রাবের জন্য দায়ী যোনিতে থাকা উপকারী ব্যক্টেরিয়ার সংখ্যা কমে যাওয়া। কোনওভাবে এই উপকারী ব্যক্টেরিয়া কমে গিয়ে ক্ষতিকর ব্যক্টেরিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়। যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ক্যানডিডা নামে ডাকা হয়। এর জন্য স্রাব চাকা চাকা হয়ে যায়। এটা এক ধরনের ফাংগাল ইনফেকশন। সাধারণত কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে থাকলে যোনিপথে অনেক সময় উপকারী ব্যক্টেরিয়ারা মারা পড়ে। এর বদলে সেখানে ফাংগাসের দাপট বেড়ে যায়। সেই থেকে সংক্রমণ হয়। অ্যান্টি ফাংগাল ওষুধ দিয়ে এটা সারানো হয়। কখনও মুখ দিয়ে খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। অথবা যোনিতে লাগানোর কোনও ওষুধ দিয়ে এই ফাংগাল ইনফেকশনের মোকাবিলা করা হয়। এতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা জরুরি।
ধূসর বা ছাই রঙের স্রাব- এই ধরনের স্রাব-এ খুবই দুর্গন্ধ হয়। অনেক সময় পচা মাছের মতোও দুর্গগ্ধ হতে পারে। এই ধরণের স্রাবের পিছনের কারণ যোনিপথে ব্যক্টেরিয়ায় অদল বদল হয়ে যাওয়া। একে বলা হয় যে যোনিপথের সুস্বাস্থ্য পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাওয়া। আর এই কারণ স্রাবের রঙ ধূসর বা ছাই রঙের মতো হয়। দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। এই ধরনের স্রাব থেকে রেহাই পেতে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মুখ দিয়ে খাওয়ার কোনও অ্যান্টি বায়োটিক থেকে যোনিতে লাগানোর কোনও ক্রিম বা জেল সাধারণত চিকিৎসকরা এই ক্ষেত্রে দিয়ে থাকেন।
সবুজ রঙের স্রাব বা গণোরিয়া- স্রাবের রঙ সবুজ হলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এটা গণোরিয়া থেকেও হতে পারে। আবার অনেক সময় স্রাবের রঙ হলুদও হতে পারে। এক্ষেত্রে লক্ষণ যে যোনিপথে চুলকানি, তলপেটে যন্ত্রণা, পেটের ভিতরে জ্বালা ভাব, যোনিতেও একটা জ্বালা অনুভব করা যায়। সবুজ স্রাব বের হলে আক্রান্ত যেমন সাবধান হবেন তেমনি তার পরুষসঙ্গীকেও সাবধান হতে হবে। এছাড়াও এই ধরণের স্রাবে চিকিৎসা না করালে পরবর্তীতে তা জরায়ুতে সংক্রমিত হতে পারে। এর জন্য সন্তান প্রসবে অসুবিধার সম্মুখিন হতে পারে। এটা একটা যৌনবাহিত রোগ। সহবাসের মধ্যে দিয়েও ছড়ায়। তাই পরুষসঙ্গীকেও চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই এই রোগকে নির্মূল করা যায়। সময় লাগে দেড় থেকে দুই সপ্তাহ। যতদিন চিকিৎসা চলবে ততদিন সহবাস করা যাবে না।
সবুজ ও হলদে রঙের স্রাব- এতে সাধারণত রোগীরা যোনিতে চুলকানি, তলপেটে যন্ত্রণার কথা বলে থাকে। একে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে সম্পূর্ণভাবে সারিয়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রেও চিকিৎসা চলাকালীন সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে। এটাও একটা যৌন বাহিত রোগ। তাই এক্ষেত্রে পুরুষ সঙ্গীর চিকিৎসার প্রয়োজন রয়েছে।
লাল স্রাব- স্বাভাবিকভাবে লাল স্রাবে দুঃশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। মাসিকের আগে বা পরে লাল স্রাব অথবা কালচে স্রাব হতে পারে। কারণ মাসিকের সময় যোনি দিয়ে যে রক্তক্ষরণ হয় তার জেরে স্রাবের রঙ বদলাতে পারে। এই নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। তবে, লাল স্রাবের আরও কতগুলি দিক রয়েছে যেগুলি স্মরণে রাখা দরকার এবং এর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ জরুরি। যেমন- মাসিক ছাড়াই যদি লাল স্রাব আসে। সহবাসের সময় যোনিতে আঘাত লাগলে স্রাব লাল হতে পারে। কিন্তু সহবাস ছাড়া যদি লাল স্রাব আসে তাহলে জরায়ুতে সংক্রমণ বা ক্যানসারের জন্যও তা হতে পারে। এর জন্য একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়াটা প্রয়োজন। এমনকী, মাসিক যাদের বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা মেনোপজ হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে যদি স্রাবের রঙ লাল বা কালচে লাল অথবা গোলাপি বা ফিকে লালও হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন আছে। কারণ এটা জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ। তবে, জরায়ু ক্যানসার হয়েছে কি না তা একজন চিকিৎসক সুনির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমেই বলতে পারবেন। তাই এটাকে হেলাফেলা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যান। ক্যানসার হলেও তাদের যত দ্রুত চিহ্নিত করা যাবে চিকিৎসায় সাফল্যের হার তত বেশি। অনেক ক্ষেত্রে বয়স্ক মহিলারা এই নিয়ে কথা বলতে চান না। লজ্জা ভুলে তারাও দয়া করে পরিবারের সদস্যদেরকে বিষয়টি জানান। তাহলে চিকিৎসা শুরু করার একটা জায়গা থাকে।
যোনিকে কীভাবে পরিস্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখবেন
অনেকে যোনির মধ্যে সাবান বা শ্যাম্পু লাগান। এটা একদম করবেন না। যোনি নিজেই তার স্বাস্থ্য বজায় রাখে। নারীর শরীরের এই অঙ্গ এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে এর সেলফ প্রোটেকশন পাওয়ার রয়েছে। যোনিপথে এমনকিছু চালনা করবেন না যা থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। খুব বেশি হলে যোনির উপরে সাধারণ সাবান দিয়ে পরিস্কার করতে পারেন। এবং শুকনো নরম কাপড় দিয়ে জায়গাটা মুছে নিতে হবে। যোনি-তে যাতে সংক্রমণ না হয় তার জন্য সুতির অন্তর্বাস পরুন। মাসিকের সময় ৬ ঘণ্টার বেশি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করবেন না। বাড়িতে থাকলে কাপড়ের ন্যাপকিন ব্যবহারের চেষ্টা করুন। আর অবশ্যই আঁটোসাঁটো অন্তর্বাস পরবেন না যাতে যোনিতে চাপ তৈরি হয়।
আরও পড়ুন- আরও বেশি করে সস্তা, গতকালের তুলনায় একলাফে কমল সোনার দাম, রূপোর দামেও চমক
আরও পড়ুন- প্লাস্টিক ব্যবহারে ফের জাড়ি হল নিষেধাজ্ঞা, নয়া নির্দেশিকা প্রকাশ CPCB-র
আরও পড়ুন- স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে Ego-র লড়াই বেড়েই চলেছে, এই কয়টি উপায় সম্পর্ক সুস্থ রাখুন