মহারাষ্ট্রের স্কুলছুট যুবকটি স্বপ্ন দেখেছিল স্বাধীনতা দিবসের দিন নিজের তৈরি হেলিকপ্টারে চড়ে উড়তে। মঙ্গলবার সেই কপ্টারের ডানাতেই কেটে গেল তার গলা।
স্বপ্ন দেখেছিল ২৪ বছরের যুবকটি। নিজের জন্য নয়, নিজের গ্রামের জন্য। দেশের মানচিত্রে নিজের গ্রামের নাম তুলে আনার জন্য। আর তাই ক্লাস এইটে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া ছেলেটি, নিজের বিদ্যে আর ইউটিউব ভিডিওর জোরে হেলিকপ্টার বানাতে চেয়েছিল সে। থ্রি ইডিয়টসের ব়্যাঞ্চোর মতো ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের দিন নিজের তৈরি হেলিকপ্টারে চড়ে উড়ান লাগিয়ে, সকলকে চমকে দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু, যে ডানায় ভর করে স্বপ্নের উড়ান লাগাতে চেয়েছিল সে, সেই ডানাই কেড়ে নিল তার স্বপ্ন।
ক্লাস ইটে পড়াকালীনই স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল মহারাষ্ট্রের যভৎমল জেলার মহাগাও মহকুমার ফুলসোয়াঙ্গি গ্রামের ছেলে শেখ ইসমাইল শেখ ইব্রাহিম। বদলে গরীব পরিবারের ছেলেটি যোগ দিয়েছিল দাদার গ্যাস ওয়েল্ডিং বা ঝালাইয়ের দোকানে। অল্প সময়ের মধ্যেই এই কাজে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছিল সে। আলমারি থেকে এয়ারকুলার - ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের পাত ব্যবহার করে, ঘরোয়া বিভিন্ন জিনিস তৈরিতে তার ছিল জুড়ি মেলা ভার। এই কাজে নিজের দক্ষতার পরিচয় পাওয়ার পরই তার মাথায় চেপেছিল, গ্রামের জন্য কিছু করার ইচ্ছা। শুরু হয়েছিল স্কুলছুট ছেলের হেলিকপ্টার তৈরির স্বপ্নের প্রকল্প।
ইউটিউব ভিডিও দেখে 'স্থানীয় ব়্যাঞ্চো' হয়ে ওঠার যাত্রাটা তার মোটেই সহজ ছিল না। ইউটিউব ভিডিও দেখে নকশাটা দ্রুত রপ্ত করে ফেলতে পারলেও, গরীব পরিবারের ছেলেটির, কপ্টার তৈরির প্রয়োজনীয় সকল সামগ্রী জোগার করতে লেগেছিল দুই বছরেরও বেশি। তারপর ধাতব রড, পাত ইত্যাদি ঝালাই করে করে বানিয়ে ফেলেছিল এক আসন বিশিষ্ট একটি ছোট্ট কপ্টার। ইঞ্জিন হিসাবে ব্যবহার করেছিল পুরোনো একটি মারুটি ৮০০ গাড়ির ইঞ্জিন। তার ডাকনাম ছিল মুন্না, কপ্টারটির নাম সে দিয়েছিল মুন্না হেলিকপ্টার। কপ্টারটি বানানোর পর থেকে মাঝে মাঝেই সে তার উড়ান পরীক্ষা করত, আর পরীক্ষার ফল অনুযায়ী কিছু অদলবদল করত। শেষ পরীক্ষায় মাটি থেকে ৫ ফুট উচু পর্যন্ত উড়েছিল ইসমাইলের তৈরি কপ্টারটি।
এরপর নিজের গ্রামকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি দিতে তার আর একটি কাজ করাই বাকি ছিল। কপ্টারটি জনসমক্ষে আনার জন্য সে বেছে নিয়েছিল ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের দিনটি। ওইদিন নিজের তৈরি হেলিকপ্টারে করে গ্রামের আকাশে ওড়ার সাধ ছিল ইসমাইলের। কিন্তু, তার আগে একবার নিজের সৃষ্টিকে শেষবারের মতো পরীক্ষা করার প্রয়োজন ছিল। সেইমতো গত মঙ্গলবার, অর্থাৎ ১০ অগাস্ট রাতে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ইসমাইল তার হেলিকপ্টারটির উড়ান পরীক্ষা করতে গিয়েছিল। কিন্তু, ইসমাইলের স্বপ্নের ডানা কেটে নিয়েছে নিয়তি।
আরও পড়ুন - ভারতের প্রথম মহাকাশ পর্যটক হতে চলেছেন কেরলের এই ব্যবসায়ী, খরচ করেছেন ১.৮ কোটি টাকা
আরও পড়ুন - Nirbhay Cruise Missile - সফল দেশি ইঞ্জিন, তাও মাঝপথে পড়ে গেল ডিআইডিওর ক্ষেপণাস্ত্র
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে ইসমাইলের বন্ধু সচিন উবালে-কে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, ওই রাতে ইসমাইল নিজের তৈরি কপ্টারটির পাইলটের আসনে বসে, তার ইঞ্জিন চালু করেছিলেন। উৎসাহী বন্ধুরা একটু দূরে দাড়িয়ে ভিডিও রেকর্ড করছিলেন সেই মুহূর্তটি। এই অবধি সব ঠিকই ছিল। কিন্তু, এরপরই ঘটে বিপত্তি। কপ্টারের ডানার গতি বাড়তেই, লেজের অংশের ঘুর্ণায়মান ডানার একটা অংশ খুলে ছিটকে এসে লাগে প্রধান ঘুর্ণায়মান ডানাটিতে। আর তারপর প্রধান ডানার একটা অংশ ভেঙে, অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসে এসে বিধে যায় সরাসরি ইসমাইলের গলায়।
তার বন্ধুদের মোবাইল ক্যামেরায়, ইসমাইলের ওড়ার ভিডিওর বদলে বন্দি হয়েছে সেই দুর্ঘটনার দৃশ্য। তাতে দেখা যাচ্ছে কেউ কিছু বোঝার আগেই চালকের আসন থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন ইসমাইল। এরপরই উড়ান পরীক্ষা দেখতে জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা ছুটে যান ইসমাইলের কাছে। তাকে দ্রুত পুসাদের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কিন্তু, ততক্ষণে তার চিকিৎসার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বুধবার তাকে সমাধিস্ত করা হয়।
মুন্না চলে গেলেও রয়ে গিয়েছে মুন্না হেলিকপ্টার। তবে সেটিকে আপাতত বাজেয়াপ্ত করেছে স্থানীয় পুলিশ। সেইসঙ্গে ইসমাইলের দাদা ও বন্ধুদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করছে তারা। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত হেলিকপ্টারটি তাদের হেফাজতেই থাকবে।
তবে ইসমাইলের বন্ধুরা জানিয়েছেন, নিয়তির খেলা ছাড়া এই ঘটনাকে আর কিছু বলা যায় না। কারণ ইসমাইল, তার হেলিকপ্টার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময়, সবসময় হেলমেট এবং হেডফোন ব্যবহার করত। কোনওদিন, এই দুই সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া তাকে কপ্টারের চালকের আসনে বসতে দেখা যায়নি। শুধু ওইদিনই তিনি কোনওরকম সুরক্ষা ছাড়াই ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন। স্থানীয় ব়্যাঞ্চোর খ্য়াতি কিন্তু, তার গ্রাম ছাড়িয়ে আশপাশের এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ইসমাইলের মৃত্যুর ধাক্কায় স্বাধীনতা দিবসের আগে, ফুলসোয়াঙ্গি ও তার আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের হাওয়া এখন ভারি হয়ে আছে।