মার্গারিটা দ্বীপের সান আন্তোনিও কারাগারকে বাইরে থেকে দেখলে আপাত দৃষ্টিতে যে কারও আর পাঁচটা জেলের মতোই মনে হবে। কেবল তাই নয় ভেনেজুয়েলাতে আর যে কটি জেল রয়েছে তার সঙ্গে আন্তোনিও কারাগারের কোনও ফারাক খুজে পাওয়া যাবে না বাইরে থেকে দেখলে। কারণ সে দেশের অন্য সব কারাগারের মতো এখানেও সবুজ পোশাক পরা কারারক্ষী কারাগারের প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছেন। ওয়াচ টাওয়ার থেকে কারারক্ষীরা কারাগারের ওপর সুতীক্ষ্ণ নজরদাড়ি চালাচ্ছে। যে কেউ চাইলেই কারাগারের ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
বাইরের চেহারার সঙ্গে ভেতরের ছবিটা যে অনেকটা আলাদা সেটা কারাগারের মধ্যে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। একবার যদি কেউ অনুমতি নিয়ে মার্গারিটা দ্বীপের সান আন্তোনিও কারাগারের ভেতরে পৌঁছতে পারে, তবে তার আর কারাগার মনে হবে না। যদি কেউ কারাগারের মধ্যে মদের বার, প্লে-বয় ক্লাব, নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত- এসব দেখে তার কি মনে হবে, যে এটা দোষীদের সাজাপ্রাপ্ত দোষীদের কারাগার! তেমনি ওই কারাগারের মধ্যে প্রবেশ করার পরও মনে হবে এটি মার্গারিটা দ্বীপ নয়, লাস ভেগাসের কোনও অভিজাত রেড লাইট এলাকা।
এই কারাগারে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে প্রায় দুহাজার বা তার সামান্য কিছু বেশী কারাবন্দী রয়েছে। তবে তাদের সকলেরই একটি নির্দিষ্ট পরিচয় আছে। তারা প্রত্যকেই দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের মস্ত মাদক ব্যবসায়ী। কিন্তু মার্গারিটা দ্বীপ তাদের জন্য এক ভূস্বর্গ। এই দ্বীপকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাদক ব্যবসা ও পাচার চক্র। আমেরিকা, মেক্সিকো সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মাদক প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই দ্বীপটি।
মাদক ব্যবসা এখানে ওপেন সিক্রেট হলেও, মাদক পাচারের অভিযোগে যদি কেউ গ্রেফতার হয়, তবে তাকে এই কারাগারে বন্দী রাখা হয়। এই কারাগারের মহিলা ও পুরুষদের জন্য আলাদা সেল বা কারাকক্ষ থাকলেও কারাগারের খোলা মাঠে তারা অবাধ এবং নিয়ন্ত্রণহীন মেলামেশা করতে পারে।
এখানে বন্দীরা অবাধে মাদক সেবন ও ধূমপান করে। কেবল ধূমপান নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিজের জনপ্রিয় রেগা মিউজিকের তালে তালে বন্দীরা নাচছে আর মনের ফুর্তিতে আকাশের দিকে ধোঁয়া ফুঁকছে। এখানেই শেষ নয়। বন্দীদের বিনোদনের জন্য কারা কতৃপক্ষ সেই মাঠের মাঝখানে মোরগ লড়ায়ের ব্যবস্থা করেছে। সেই লড়াই ঘিরে বসে জুয়ার আসর। পাশাপাশি কয়েদিরা নিজেদের খরচেই উপরি-বিনোদনের জন্য গড়ে তুলেছে মদের বার ও প্লে-বয় কেন্দ্র। চারটি সুইমিং পুলও আছে সেখানে। সেখানে বিকিনি গার্লের সাহচর্য নেন পুরুষ বন্দীরা।
কথায় বলে টাকা ঢাললে বাঘের দুধও মেলে। সান আন্তোনিও কারাগারের ভেতরে ঢুকলে মনে হবে কথাটা যেন অনেকটাই সত্যি। যেসব বন্দীদের অনেক টাকা আছে, তারা টাকার বিনিময়ে সেখানে যেকোনো কিছু সংগ্রহ করতে পারেন। অনেকের সেলে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও এয়ার কন্ডিশনারের মতো অভিজাত ব্যবস্থা আছে। বিনোদনের জন্য আছে আরও নানা আয়োজন। সম্প্রতি কারাগারের ভেতরে বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিছু বন্দী কারাগারের বাইরে থাকার চেয়ে কারাগারের মধ্যে থাকাটাকেই বেশি নিরাপদ মনে করে।
অনেকেই এই কারাগার দেখতে আসেন। তার যখন কারাগারের ভেতরে যান তখন তাদের কড়া তল্লাশি নেওয়া হয়। কিন্তু যখন বের হন তখন কোনও তল্লাশি করা হয় না। ফলে তারা কয়েদিদের কাছ থেকে নির্বিঘ্নে মাদক সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে পারেন। এভাবে কারাগারের অভ্যন্তরেই মাদকের একটি বিশাল চক্র গড়ে উঠেছে। মাদক পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার হলেও, তারা কারাগারের ভেতরে নিরাপদে মাদক ব্যবসা করছেন।
ভেনেজুয়েলা সরকার যে স্বেচ্ছায় এমন ব্যবস্থা করেছেন তা কিন্তু নয়। মূলত মাদক পাচারকারী চক্রের প্রভাব ও হুমকিতেই সরকার বাধ্য হয়ে এমন পরিস্থিতি মেনে নিয়েছে। তবে শর্ত একটাই। এত সুযোগ সুবিধা থাকলেও পালানোর উপায় নেই তাদের!
যে কারণে কারাগার যে সবসময় শান্ত থাকে এমন নয়। মাঝেমধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মানবাধিকার সংস্থাগুলির রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র ২০১০ সালে এখানে সংঘর্ষে ৪৭৬ জন কারাবন্দী নিহত হয়েছেন, যা দেশটির মোট কারাবন্দীর এক শতাংশ। ২০১০ সালে দেশটির কারাগারে মোট বন্দীর সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৫২০ জন।