সমাজকে বদলানোর জন্য হাতে গোনা কয়েক জনকে নিয়ে নব্বই-এর দশকে যাত্রা শুরু করেছিল প্রয়াসম। পথ নাটিকা থেকে শুরু করে পুতুল নাচ, ড্রান্স- এমন সব ফর্মেশনের মধ্যে দিয়ে চালানো হয় সচেতনতা অভিযান।
ছোট ছোট গল্প। ছোট ছোট কথা। কোলাহলমুখর জীবনে কোথায় কখন চাপা পড়ে থাকে কারওরই নজরে আসে না (Bad And Beautiful World Short Film Festival)। কিন্তু বেরিয়ে আসতে চায় সেই সব কাহিনি (LGBT Rights)। ডানা মেলতে চায় এই ইচ্ছেপূরণের লক্ষে। আদৌ কি পারে তারা ডানা মেলতে? নাকি পড়ে থাকা অসহায়-অবহেলায় ভরা এক রিক্ত বেদনার বেড়াজালে? কেমন সেই সব কাহিনির ছবিটা? এমন অসব আশপাশে পড়ে থাকা কাহিনি নিয়ে এবার ডানা মেলেছে ব্যাড অ্যান্ড বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল (Prayasam Visual Basics)। যারা হয়তো আমাদের চিরাচিত জীবন-চরিত থেকে একটু আলাদা, একটু ভিন্ন। কিন্তু তারাও বাঁচতে চায়। তারাও আশার আলোর এক উজ্জ্বল দিনের অপেক্ষায় থাকে। এমন সব কাহিনির মোড়কে সমকামী ইস্যুকে তাদের সিনেমার ভাষায় তুলে ধরেছে ব্যাড অ্যান্ড বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। মোট ৮টি ছবি। ৮টি গল্প।
দ্বিতীয় পুরুষ- যার ইংরাজি নাম সেকেন্ড পার্সন (Second Person)। গল্প- তনয় কাজ করে একটি মনোরোগ সংস্থায়। সেখানেই একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ইকবালের। এক অন্য মানুষ। অন্য পুরুষ যেন ইকবাল। চিরাচরিত পুরুষালি ধারনার বাইরে যেন বিরাজ করে ইকবাল। যে জীবনকে এক অন্য চোখে দেখে। ইকবালের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতে থাকে তনয়। ইকবাল যেন জীবনের এক অন্য স্রোতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। তনয়ের মানসিক সীমানাকে ফালা-ফালা ছিড়ে দেয় ইকবাল। এভাবেই ঘটনা পরম্পরায় এগিয়ে চলে কাহিনি। অভিনয়ে- তনয়, ইলিয়াস, অঙ্কিত, সুশ্রী। ডিওপি- সেলিম, মণীশ ও আমান। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- আকসলাইফ। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার। ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর- প্রয়াসম ভিশুয়াল বেসিকস।
ধরা পড়ে গিয়েছি আমি- যার ইংরাজি নাম গোচা (Gotcha)। বাবু কাজ করে তাঁর বাবার লন্ড্রিতে। একদিন সেখানেই দেখা হয়ে যায় সদ্য বিবাহিত দম্পতির সঙ্গে। লন্ড্রিতে ধোতি এবং কাপড় দিতে এসেছিল তারা। সেটা ছিল সপ্তাহের শেষের একটা দিন। কিন্তু বাবু তখন মনে মনে বুনে চলেছে এক গল্প। এক স্বপ্ন। যেখানে বিরাজ করে সদ্য বিবাহিত সেই দম্পতি। অভিনয়ে- অমরজিত, দীপ্তার্ক, নন্দিতা, শ্বেতা। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- আতেশ। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
দত্ত- ইংরাজি নাম অফার (Offer)। রণিত এক আদ্যপ্রান্ত পরিবার অন্তপ্রাণ ছেলে। রণিতের বিবাহযোগ্য বোনের সম্বন্ধ দেখা চলছে। যারাই বোনকে বিয়ে করবে বলে দেখতে আসছে, রণিত দেখছে এরা সকলেই তাঁর পরিচিত। এদের সঙ্গে এমন কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে যা অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়। রণিত ছেলে হলেও তাঁর আবার এক বয়ফ্রেন্ড রয়েছে। নাম শ্যাম। সে আবার রণিতের সঙ্গে দেখা করতে চলে আসে। কিন্তু শ্যামের কাছে এমনকিছু লুকিয়ে ফেলে রণিত যা হয়তো লুকানোর কথা ছিল না। এভাবেই এগিয়ে চলে কাহিনি। অভিনয়ে- রাহুল, গৌরব, দেবাশিস, সপ্তর্ষী, প্রশান্ত, মঞ্জু। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- সপ্তর্ষষী। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
দেয়া-নেয়া- ইংরাজি নাম কুইড প্রো কো (Quid Pro Quo)। সমাজের শ্রেণিবিভাজন কীভাবে আজও মানুষকে ভালোবাসার এক্তিয়ার পার করতে দেয় না সেই কাহিনি তুলে ধরেছে এই ছবিয যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে দুই সমকামী পুরুষ শ্রেণি বিভাজনের জাতাকলে পড়ে একে অপরের থেকে দূরে চলে যায়। প্রসাদ ক্যান্টিন থেকে সল্টলেকের বিভিন্ন অভিজাত বাড়িতে খাবার সাপ্লায়ের কাজ করে আসগর। একদিন এভাবে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কর্পোরেট লইয়ারের। যার সুন্দর চেহারা আসগরকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে যায়। আসগর ভেবেছিল হয়তো সেই কর্পোরেট লইয়ার তাঁকে লক্ষ্য-ই করেনি। অথচ যখন এই সম্পর্ক এক রোমান্টিক আবহে প্রবেশ করার অপেক্ষায় তখনই ভেঙে যায় সম্পর্ক। অভিনয়ে- সুজন, অভিক, মিলি, গোপাল। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- মণীশ। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
দূরবীন- ইংরাজি নাম বাইনাকুলারস (Binoculars)। মৃদুল এক সাংবাদিক। একদিন তাঁর জীবনে প্রবেশ ঘটে অর্ণ-র। যার চরিত্রের স্বতস্ফূর্তা, প্রাণপ্রচূর্য আকর্ষিত করতে থাকে মৃদুলকে। বাবা মৃণ্ময়ের জীবনদর্শন একক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে অনুপ্রাণিত করতে থাকে। ভেবে কূল করতে পারে না মৃদুল। অথচ জীবনে সে এক পাকাপোক্ত এবং দীর্ঘ সময়ের সম্পর্কের অপেক্ষায়। কী করবে মৃদূল। অর্ণ-র সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যত কোন বাঁকে? অভিনয়ে- শান্তনু, দীপ্তার্ক, শ্বেতা, রণিত। ডিওপি- সেলিম, মণীশ ও আমান। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- আকসলাইফ। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
দেখা- ইংরাজি নাম পারসিভ (Perceive)। এক ফুটপাতের উপরেউ বাবার সঙ্গে শেষ সমঝোতা করার বিষয়টা ঠিক করে নিয়েছে অঙ্কুর। বাবা-র অপেক্ষায় সে। মনে হচ্ছে এই দুজনের জীবনের সমস্ত স্থানগুলো কোনও না কোনওভাবে একে অপরের দখলে চলে গিয়েছে। পড়ে রয়েছে শহরের এই ফুটপাত। আপাতত অঙ্কুর এবং তাঁর বাবার কাছে এটা যেন নিরপেক্ষ স্থান। অঙ্কুর পারবে কি বাবার সঙ্গে তাঁর মনের দূরত্বটাকে মিটিয়ে ফেলতে ? তাঁর মনের মানসিকতাকে কি বুঝতে পারবে বাবা? ছেলে ও বাবার মধ্যে সবকিছু কি শেষ হয়ে যাবে না একে অপরের স্বরূপটাকে আকড়ে ধরে ফের কাছাকাছি আসতে পারবে? অভিনয়ে- বিশা, কৌস্তভ। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- সেলিম। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
দখিনা- ইংরাজি নাম আমস (Alms)। শহর জুড়ে রয়েছে এসকর্ট সার্ভিস। এমনই এক এসকর্ট সার্ভিসের হয়ে পুরুষ যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করা। একদিন এক ক্লায়েন্টের কাছে যেতেও হয়। কিন্তু সেদিন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। কেমন সেই কাহিনি? কী হয় গল্পের? জানতে হলে অবশ্যই চোখ রাখতে হবে দখিনায়। অভিনয়ে অরিজিত, জাফিরুল। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- দেবাশিস। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
ডাম্বেল (Dumbell)- বাংলা নাম-ই যেহেতু ইংরাজি নামে তাই এই ছবিতে দ্বিতীয় কোনও নাম নেই। এই ছবির মুখ্য চরিত্র বিষাণ। জীবনের রোজকার চলাফেরায় এক অন্য অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয় সে। এতদিন নিজেকে নিয়ে যে ধারনা পোষণ করত তা যেন এক লহমায় বদলে যায়। বদলে যায় তার নিজের সেক্সুয়ালিটি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন। যার উত্তর সে বুঝতে পারে। কিন্তু কোথাও যেন দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে একটা সময় জড়িয়ে পড়ে বিষাণ। এই ভাবেই পরতে পরতে খুলতে থাকে কাহিনি। অভিনয়ে- সুব্রত, সুজিত, শুভ্র, রূপা,শানু। ডিওপি- সেলিম, মণীশ। গল্প- প্রয়াসম। চিত্রনাট্য- অভিজিত। কস্টিউম- দুয়োরানির সংসার।
এবারের ব্যাড অ্যান্ড বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে কোনও পরিচালকের নাম আলাদা করে ঘোষণা করা হয়নি। প্রতিটি ছবিতেই পরিচালক হিসাবে প্রয়াসম ভিশুয়াল বেসিকের নাম রাখা হয়েছে। আর প্রযোজক হিসাবে নাম রাখা হয়েছে প্রয়াসম অ্যাডোবি টেকিং আইটি গ্লোবালের নাম। তবে, ফোটোগ্রাফি, স্ক্রিপ্ট-এর যারা কাজ করেছে তাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। প্রয়াসম-এর চিফ মিডিয়া কমিউনিকেশন অফিসার প্রশান্ত জানিয়েছেন, 'এবার বেশকিছু স্ট্র্যাটেজিক্যাল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই এবার আলাদা করে কোনও পরিচালকের নাম ঘোষণা করা হয়নি। এছাড়াও এবারের ছবি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রদর্শিত হবে। বিভিন্ন দেশে ছবির প্রদর্শন নিয়েও কথা চলছে। এবার এলজিবিটি ইস্যুকেই থিম করা হয়েছে। ফলে এই ছবিগুলোকে ঘিরে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে। '
প্রয়াসমের সর্বোচ্চ কর্তা তথা মেন্টর অম্লানকুসুম গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছেন, প্রতিবারের মতো এবারও প্রতিদিন প্রয়াসম প্রণাম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে এই অনুষ্ঠান। এবারের থিমে সবচেয়ে বেশি করে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এলজিবিটি ইস্যুকে। শুধু শর্ট ফিল্মের মাধ্যমে নয় প্রতিদিন প্রয়াসম প্রণামে যে বিভিন্ন সূচি নেওয়া হয়েছে তাতেও এলজিবিটি কমিউনিটির কথা এবং গল্প তুলে ধরা হচ্ছে। এতে যেমন স্টোরি টেলিং রয়েছে তেমনি রয়েছে ডান্স ড্রামা থেকে শুরু করে কত্থক ড্রান্স ফর্মেশন। বলতে গেলে প্রতিদিন প্রয়াসম প্রণাম এবার নিজেকে অন্য একটা উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। আর সবচেয়ে বড় কথা প্রয়াসম-এর এবার ২৫ বছর পূর্তি চলছে। সুতরাং এই ২৫ বছর পূর্তিতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
সমাজকে বদলানোর জন্য হাতে গোনা কয়েক জনকে নিয়ে নব্বই-এর দশকে যাত্রা শুরু করেছিল প্রয়াসম। পথ নাটিকা থেকে শুরু করে পুতুল নাচ, ড্রান্স- এমন সব ফর্মেশনের মধ্যে দিয়ে চালানো হয় সচেতনতা অভিযান। যাতে মানুষ তাঁর নিজেরে চারপাশটা সম্পর্কে অবগত হয়। এভাবেই প্রয়াসম বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করতে থাকে চাইল্ড কমিউনিটি ডেভলপার। আজ প্রয়াসমের হাত ধরে চেহারা বদলেছে বিভিন্ন এলাকা, সচেতনতার আবহে মানুষ আঁকড়ে ধরতে পেরেছে এক সুস্থ-সবল জীবনকে। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে পেরেছে নিজেকে। শুধু কলকাতা বা ভারতবর্ষ নয় এই মুহূর্তে প্রয়াসমের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে ইউনিসেফ থেকে শুরু করে আমেরিকা, নরওয়ে, কেনিয়া-র মতো দেশ। গেটস ফাউন্ডেশনের মঞ্চ থেকে টেড এক্স-এর মঞ্চে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রয়াসমের কমিউনিটি ডেভলপাররা। এহেন প্রয়াসমের হাত ধরেই গত কয়েক বছর ধরে ডানা মেলেছে ব্যাড অ্যান্ড বিউটিফুল ওয়ার্ল্ড শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।