প্রথমে কাঁসরের টুংটাং। আর সেই আওয়াজের মাত্রা ধরেই সঙ্গত ধরল ঢোল। ঢোলের বাদ্যকে এবার মাত্রা দিল ঢাক। বলতে গেলে আশ্বিনের শুভ্র-নীল আকাশের বুক চিরে তখন তোলপাড় করছে ঢাক আর ঢোলের বাদ্যি। সঙ্গে গ্রাম-বাংলার মেঠোয়ালি সুরে সানাই-এর যুগলবন্দি। মনে হচ্ছে দ্বাদশী-তেও যেন কৈলাশ থেকে নেমে এসেছেন উমা। ঢাক-ঢোলের বাদ্যিতে দিক-চক্রবালে এক অদ্ভুত মাদকতা। ঊচ্ছ্বাসে মাতোয়ারা ঢাক-ঢোলের বাদক। এক অপার অসীম আনন্দে শরীর জুড়ে এক শিহরণ আলোড়ন খেলে যায় সৃজন ও অনির্বাণের। প্রত্যেকটি বোলের শেষ আর সকলেই 'জয়গুরু জয়গুরু' বলে একে একে অভিনন্দন জানানোর পালা। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যেমন আসর জমে উঠলে শিল্পীর উদ্দেশে উড়ে আসে 'বা-ওস্তাদ বা!'। তেমনি গ্রাম-বাংলার মেঠোয়ালি ঢাক-ঢোল-সানাই-এর বাদ্যি শেষে জয়গুরু বলাটাই নিয়ম।
আসলে এই আয়োজন রেড-রোডে দুর্গা কার্নিভালের জন্য। রেড রোড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে দুর্গা কার্নিভালে আয়োজন এই বছর চার-এর মাইল ফলক ছুঁয়েছে। সপ্তমীতেই গ্রামবাংলায় ঢাক-ঢোল বাদকদের কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছিলো। তাই বিজয়া দশমী মিটতেই বুধবার থেকে শিল্পীদের ঠিকানা হয়েছে মুকুন্দপুরের লোক সংস্কৃতি গ্রাম। বৃহস্পতিবারও কাতারে-কাতারে ঢাক-ঢোল নিয়ে শিল্পীরা হাজির হয়েছেন এই ঠিকানায়।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল কলকাতা শহরের উপকন্ঠে ব্যারাকপুর ছাড়াও বর্ধমান, পূর্ব মেদিনীপুর মিলিয়ে অন্তত শতাধিক শিল্পী ঢাক-ঢোল নিয়ে নেমে পড়তে চলেছেন দুর্গা কার্নিভালে। তাঁদের বাজনার আওয়াজে শুক্রবার তাই নিশ্চিতভাবেই কেঁপে উঠবে রেড রোড।
এত শিল্পী! এলাকা অনুযায়ী বোলের রকমফের! তাল কাটার-ই কথা। অনুষ্ঠানের পরিচালক সৃজন সরকার রবীন্দ্র ভারতী-র ছাত্র। মিউজিক নিয়ে সেখানে স্নাতকোস্তরের পড়াশোনা চলছে। তাঁর কথায় সুর-শব্দ-তাল-লয় মানেই একটা নেশা। আর সেই নেশা যখন কাজ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাতে থাকে একটা ভালোলাগা। আর সেই ভালোলাগা থেকেই শতাধিক শিল্পী-র এই দলকে নিয়ে কাজ। সৃজনের কথায় তাঁর কাজ শুধু এক এলাকার শিল্পী-র সুর-তাল-লয়-কে আর এক এলাকার শিল্পীর বাজনার সঙ্গে সেঁতু বন্ধন।
কার্নিভালে অংশ নেওয়া এই শিল্পীদের দলে যেমন রয়েছে ঢাক-ঢোল এবং সানাই, তেমনি রয়েছে ধুনুচি নৃত্য এবং নৃত্যকলা পরিবেশনও। এই সমগ্র অনুষ্ঠানটির মূল ভাবনাকারী এবং রূপায়নের দায়িত্বে রয়েছেন অনির্বান। পেশা এবং নেশায় একজন থিয়েটার শিল্পী অনির্বান। ভালবাসেন পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে। তাই কার্নিভালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল মঞ্চের সামনে যে সিগনেচার অনুষ্ঠান হতে চলেছে তা রূপায়নের দায়িত্বেই রয়েছেন অনির্বান। তাঁর মতে, এ এক অসাধারণ চ্যালেঞ্জ। নিজে শিল্পী- তাই অন্য শিল্পীদের একত্রিত করে এমন একটা কাজ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর হৃদয় ও মনকে নাড়া দিয়ে দিয়েছে। তাঁর কাছেই মিলল এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের হিসাবটা। ঢাকি শিল্পী অন্তত ৬০, ঢোলে আরও ৪০ এবং ধনুচি ও নৃত্যশিল্পী মিলিয়ে সংখ্যাটা ১২০ ছাড়়িয়ে যাওয়ার কথা।
কথা হচ্ছিল ধনুচি দলের সদস্য লীলা দাসের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাঁদের অন্তত ২০ জনের একটি দল সোদপুরের ঘোলা থেকে এসেছে। এঁরা সকলেই অংশ নেবেন কার্নিভালে। তাঁদের দলের প্রধান সঞ্জীব প্রধান। ধনুচি দলের নেতৃত্বের অগ্রভাগে তাঁরই থাকার কথা। এই আলাপ-চারিতার মাঝেই উপস্থিত একদল নৃত্যশিল্পী। যার নেতৃত্বে এককালের প্রখ্যাত নিউজ প্রেজেন্টার ঊর্মিমালা ভৌমিক। তাঁর-ই নাচের স্কুলের মেয়েরা এই কার্নিভালে অংশ নিচ্ছে। এঁদের সংখ্যাটাও অন্তত দশ।
এত সব কথার মাঝেই ফের বেজে উঠল ঢোল আর ঢাক। কাঁসরের বাজনায় এক-দুই-তিন তালের ছন্দ মিলোতেই শুরু হয়ে গেল সানাই-এর আওয়াজ। একদল শিল্পী দৌঁড়লেন রিহার্সালে অংশ নিতে। আর বাবা আর তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা- তারপরেই তো বাজনার আওয়াজে কাঁপিয়ে দিতে হবে রেড রোড-র কার্নিভাল। এটাই তো সময়, কারণ মার্কিন মুলুকের হার্ড-রকের ভক্তদেরও দেখিয়ে দেওয়া দুর্গাপুজোর ঢাকের বাদ্যি-ও কোনওভাবে 'মেটালিকা'- র থেকে কম কিছু নয়।