গরিবির মুখে থাপ্পড় মেরেই রিক্সা নিয়ে লাদাখ-পুরী, এবার ভরা বর্ষায় সিয়াচেনের পথে কলকাতার সত্যেন

সত্যেন যে রিক্সা নিয়ে সিয়াচেনের পথে সে খবর প্রকাশ্যে আসে ১ অগাস্ট। কেমন হচ্ছে সত্যেনের পথের যাত্রা? কোনও অসুবিধার সম্মুখিন হতে হল না তো কলকাতা এই রিক্সাওয়ালাকে। শুক্রবার সাতসকালেই এশিয়ানেট নিউজ বাংলার ফোন সত্যেনকে। মুহূর্তের মধ্যে ওপার থেকে ভেসে এল সেই চিরাচরিত কন্ঠস্বর। 
 

সামনে শৃঙ্গের মাথা থেকে উঠে আসছে লাল সূর্যটা। বিশাল রক্তাভ সেই গোলাকৃতির আলো যেন চারপাশে হলুদের মতো রঙে মেখে থাকা পর্বতগুলো রাঙিয়ে দিচ্ছে। হলদে রঙের সেই সব পর্বত মাঝে আবার মেটে রঙের পর্বতও রয়েছে। নিঝুম চারিপাশের সেই পর্বতের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে এক অন্যভূতি সত্যেনের। রিক্সা প্যাডেলে আরও জোরে সে পা বাগিয়ে ধেয়ে চলল আরও দূরে...। রোদের রক্তরাঙা চাকতির মধ্যে দিয়ে সে যেন ছুটে চলেছে আরও আরও দূরে-- অন্য কোথাও-- আসলে সত্যেন থামবে কি করে! কারণ তাঁকে যে পৌঁছতে হবে সিয়াচেনের কোলে। যেখানে তাপমাত্রা গরমকালেও নেমে থাকে মাইনাসে। আর শীত হলে তো দেখতে হবে না- সঠিক গরমবস্ত্র না থাকলে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে এক্কেবারে হাড়ে-হাড়ে ঠোকাঠুকি লেগে যাওয়ার উপক্রম হবে। সিয়াচেন মানে সেই হিমবাহ যা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের এক সীমানা হিসাবে পরিগণিত হয়। সেই সিয়াচেনে-র পথে এবার কলকাতার সত্যেন। সঙ্গী তাঁর রিক্সা। এই প্রতিবেদনের শুরুতে যে বাক্যগুলি লেখা হয়েছে তা শুধুমাত্র কল্পনা প্রসূত। কারণ, সত্যেনের সিয়াচেন পৌঁছতে এখনও আড়াই মাস লেগে যাবে। সবে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছে কলকাতার বুক থেকে। এখনও সে বাংলার সীমানা পার করেনি। 

সত্যেন যে রিক্সা নিয়ে সিয়াচেনের পথে সে খবর প্রকাশ্যে আসে ১ অগাস্ট। কেমন হচ্ছে সত্যেনের পথের যাত্রা? কোনও অসুবিধার সম্মুখিন হতে হল না তো কলকাতা এই রিক্সাওয়ালাকে। শুক্রবার সাতসকালেই এশিয়ানেট নিউজ বাংলার ফোন সত্যেনকে। মুহূর্তের মধ্যে ওপার থেকে ভেসে এল সেই চিরাচরিত কন্ঠস্বর। যে কন্ঠস্বর গত কয়েক বছর ধরে বাংলা তথা বিশ্বের মানুষকে শুনিয়েছে এক অবিশ্বাস্য জীবনবোধের গল্প। যে গল্প শুনে খোদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও বলে ফেলেছেন- 'আমার জীবন আপনার থেকে অনেক সহজ-সরল ছিল, আপনি যা করেছেন তা ব্যাটে-বলে ছক্কা মেরে করা যায় না।' তা কেমন হচ্ছে সফর? প্রশ্ন শুনেই এক্কেবারে প্রবল উচ্ছ্বসিত সত্যেন। জানিয়ে দিলেন- এখন তিনি পানাগড় থেকে দূর্গাপুরের পথে। সেখানেই রাত্রিবাস করবেন। ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে পাণ্ডুয়া থেকে তিনি বেরিয়ে পড়েছেন। তা কোন রুটে যাওয়াটা ঠিক করলেন? এমন প্রশ্ন করতেই জানিয়ে দিলেন আপাতত তিনি বাংলা ওড়িশা দিয়ে বেনারসের দিকে যাবেন, সেখান থেকে লখনই হয়ে কারনাল। এরপর পথের অবস্থা দেখে ঠিক করবেন মানালি না শ্রীনগর হয়ে সিয়াচেন। সবমিলিয়ে খুব তাড়াতাড়ি হলেও অক্টোবরের মাঝ বরাবর তিনি সিয়াচেনে পৌঁছবেন বলেও জানিয়ে দেন। 

Latest Videos

১ অগাস্ট কলকাতার নাকতলা থেকে যাত্রা শুরু করেন সত্যেন দাস। এরপর তিনি নিউটাউনে সরকারিভাবে যাত্রা শুরু করেন। সেখানে বিশিষ্ট অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক তাপস চট্টোপাধ্যায়, রাজ্যের মন্ত্রী সুজিত বসু। এরপর ২ দিন দমদমে শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নিয়ে পাকাপাকি বেরিয়ে পড়েছেন সত্যেন। জানালেন, রিক্সা চালানোর জন্য পা-এর কাপ মাসলে চাপ পড়ে। তাই একটানা রিক্সা চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন। আর কাপ মাসলকে ঠিকঠাক বিশ্রাম দিতে হবে। না হলে সিয়াচেনের পথে সমস্য়া হতে পারে। পা এবং নিজের শরীর-কে অক্ষত রেখে এগোতে হবে বলেই তিনি মনে করেন। 

রিক্সায় এবারও তুলে নিয়েছেন সফরের খাবারের রসদ। সেই সঙ্গে নিয়ে নিয়েছেন ক্লিক্স। এতেই মোটামুটি চাল-ডাল মিশিয়ে ফুটিয়ে নেবেন। এখন পর্যন্ত যত স্থানে তিনি রাত্রিবাস করেছেন সেগুলি সবই বন্ধু-বান্ধবদের বাড়ি। রিক্সা নিয়ে অভিযান করতে করতে এই সব বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। সকলেই সারাক্ষণ খোঁজ রাখছেন বলেও জানালেন সত্যেন। বিশেষ করে বাইকারদের একাধিক সংগঠন সত্যেনের এই সফরের পিছনে রয়েছে। এরা সকলেই নানাভাবে সত্যেনকে সাহায্য করছেন। তাঁর ঘুমোনো, ওঠা-র সময় সমস্ত কিছু তারা ক্ষণে ক্ষণে খোঁজ রাখছেন। 

এমন এক অভিযানে তো খরচা-র বহর রয়েছে? প্রশ্ন শুনেই সত্যেন সাফ জানান, খরচের সমস্যা এবার অনেক কম। কারণ, অংসখ্য মানুষ তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। বাইকার ক্লাবের সদস্যরা প্রত্যেকেই তাঁকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছেন। এমনকী তাঁর এই সফরের পিছনে স্ত্রী ও কন্যার একটা বিশাল অনুপ্রেরণা রয়েছে., তাও বলতে ভোলেননি। 

আসলে সীমাবদ্ধ হওয়াটা কোনওদিনই মন থেকে মানতে পারেননি সত্যেন দাস। তাই ছোট থেকেই কখনও সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন দিঘায়। আবার কখনও দার্জিলিং, পুরী। স্ত্রী-কন্যাকে রিক্সায় চাপিয়ে একবার উত্তর ভারতও ভ্রমণ সেরে ফেলেছিলেন। রান্না-বান্নার সব সরজ্ঞাম রিক্সায় চাপিয়ে নিয়েছিলেন। আসলে সত্যেন মানেন কবি নজরুলের সেই কবিতা-কে থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগতটাকে। তা এই জগত দেখায় কোনও বাধাকেই বাধা বলে মানেন না সত্যেন। জোজিলা পাসে রিক্সা নিয়ে উঠতে গিয়ে শরীর ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও রিক্সা ঠেলে এগোতে পারছিলেন না। এরমধ্যে সন্ধ্যে। আচমকাই উদয় হল একটি লেপার্ড। অন্ধকারের মধ্যে সেই আতঙ্ক মাখার শ্বাপদের চোখগুলো দেখছিলেন সত্যেন। লেপার্ডের চোখের উপরে সমানে টর্চ মেরে রেখেছিলেন। একটু পরে পাশের নিচের খাদে লেপার্ডটি নেমে যায়। রিক্সা ওখানে রেখেই সত্যেন সামনে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে একটি সেনা ছাউনি খুঁজে পান। সেখানে রাতভর অপেক্ষার পর সকালে এসে রিক্সার কাছে আসেন। শুরু হয় সফর। এমনকী, লাদাখের পথে চরাই-উতরাই রাস্তা পার হতে বহু স্থানেই সত্যেনকে রিক্সা থেকে জিনিস পত্র নামিয়ে ফেলতে হচ্ছিল। কিছুদূর রিক্সা টেনে নিয়ে যাওয়ার পর আবার পিছনে কয়েক কিলোমিটার রাস্তা এসে ফেলে যাওয়া জিনিস নিয়ে গিয়ে রিক্সায় তুলেছেন। এভাবেই সফর তিনি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হত্যোদম হয়ে থেমে যাননি। কখনও কখনও রাস্তার মাঝে পেয়েছেন বাইকারদের সাহায্য। তাঁরাই পিছন থেকে রিক্সা ঠেলে চরাই-এর রাস্তা পার করিয়েছেন সত্যেনকে। পথের সেই বন্ধুদের আজও ভুলতে পারেননি তিনি। রিক্সা নিয়ে এমন সব অভিযানে তিনি যেভাবে সমাজের বুকে কদর পেয়েছেন তাতে মনের অনেক যন্ত্রণা মিটে গিয়েছে বলেও মনে করেন। তাঁর লাদাখ যাওয়ার রিক্সা-র অর্থ দিয়েছিলেন রামগড়ের এক দম্পতি। যে ভাবে সত্যেন মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছে তা তাঁর অভিযানের দুর্দমতাকে জয় করার মানসিকতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। মানুষ এবং পরিবারের সেই ভালোবাসাকে সঙ্গী করেই তা এবারও পথের পথিক সত্যেন। রিক্সা নিয়ে তিনি লাদাখে গিয়ে দেখা করে এসেছেন সোনাম ওয়াংচুক-এর সঙ্গে। যাকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন চেতন ভগত। রাজকুমার হিরানি বানিয়েছেন থ্রি-ইডিয়েটস নামে সিনেমা। সত্যেনকে পাশে বসিয়ে নিয়ে খাবার খেয়েছেন সোনম। এবারের অভিযানে সত্যেন এক সচেতনতাও প্রচারাভিযানও করছেন। আর তা হল বিশ্ব উষ্ণায়ণ নিয়ে। এমনকী, সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছেন প্রচুর মাস্ক। করোনা অতিমারি নিয়ে মানুষকে সচেতন করতে তিনি সারা রাস্তায় মাস্ক বিতরণ করতে করতে এগোবেন। 


"

রিক্সা নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণের ইচ্ছে সত্যেনের। আইফেল টাওয়ারের নিচে রিক্সা নিয়ে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে চান। সৌরভ গাঙ্গুলি এমন পরিকল্পনা শুনে বলেছিলেন যদি তিনি মোটর চালিত রিক্সা ব্যবহার করেন। তাহলে পথের কষ্ঠ অনেকটাই লাঘব হবে। কিন্তু, যে মানুষ  তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে বারবার জয় পেয়েছেন তিনি যে এমন প্রস্তাবে সায় দেবেন না তা সৌরভ জানতেন। সত্যেন হাসতে হাসতেই বলেছিলেন- তাহলে আর মানুষ আমায় মনে রাখবে কেন- আমি পথের দুর্দমতাকে আমার স্ট্যামিনা দিয়েই জয় করতে চাই। আপাতত এমন এক দুর্দমনিয় সাহসীকতাকে আঁকড়ে ধরে সিয়াচেনের পথে সত্যেন। 


 

 

Share this article
click me!

Latest Videos

আজ রাজ্যে উপনির্বাচনের (By Election) রেজাল্ট আউট, সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়েছে ভোটগণনা (Vote Counting)
‘সরকারকে প্রশ্ন করলেই সরকার উলঙ্গ হয়ে যাবে!’ বক্তব্য রাখতে না দেওয়ায় বিস্ফোরক Sajal Ghosh
'মোদী বাংলার কৃষকদের একটা পয়সাও দেয় না' বিতর্কিত মন্তব্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee)
‘অনেকদিন পর কেষ্টদা ফিরেছে তাই একটু বিশৃঙ্খলা হচ্ছে’ অদ্ভুত ব্যাখ্যা Satabdi-র! | Satabdi Roy News
'মাননীয়া আপনার শাড়িতে দুর্নীতির কালো ছোপ ছোপ দাগ' মমতাকে (Mamata) এ কী বললেন অগ্নিমিত্রা ?