কতখানি রবীন্দ্র বিদ্বেষী ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস

  • দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে বাঙালি মনে রেখেছে
  • রাজনৈতিক জীবন ছিল মাত্র ছ-সাত বছরের
  • নির্মাল্য, মানসী প্রভৃতি পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হত
  • ঠাকুরবাড়ির খামখেয়ালি ক্লাবের সভ্য ছিলেন
     

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে বাঙালি যেভাবে মনে রেখেছে কবি, গল্পকার কিংবা প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন দাশকে বাংলা সাহিত্য সেভাবে জায়গা দেয় নি । রাজনীতিক চিত্তরঞ্জনের দেশবন্ধু পরিচয়টি পরবর্তীকালে অন্য সব পরিচয়কে ছাড়িয়ে গেলেও, চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক জীবন ছিল মাত্র ছ’সাত বছরের। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রেসিডেন্সি কলেজ জীবনে, বিলেতে, এমনকি দেশে ফেরার পর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তাঁর মন থাকত সাহিত্যচর্চায়। নির্মাল্য, মানসী প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হত। 
চিত্তরঞ্জন দাশের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় নব্যভারত পত্রিকার ফাল্গুন ১২৯৫ সংখ্যায়। কবিতার নাম ‘বন্দী’। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মালঞ্চ’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে, প্রকাশক ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। 

আরও পড়ুন- জগদীশ চন্দ্রের বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম সহায়ক নিবেদিতা, কীভাবে আগ্রহী হয়েছিলেন তাঁর কাজে
একটা সময় চিত্তরঞ্জন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির খামখেয়ালি ক্লাবের সভ্য ছিলেন। সেই সূত্রে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রমথ চৌধুরী, প্রমুখের সঙ্গে কেবল পরিচয় নয় তাদের সঙ্গে তিনি সাহিত্যপাঠ ও সংগীতচর্চায় অংশ নিতেন। চিত্তরঞ্জন যখন দ্বিতীয়বার বিলেত যান তখন চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস ও রদেনস্টাইনকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কাব্য থেকে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে চিত্তরঞ্জন দাশও তাঁর সাগর-সঙ্গীত-এর পাণ্ডুলিপি থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন।  তবু বাংলা সাহিত্যে চিত্তরঞ্জন দাশের অবদান প্রসঙ্গে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে মূলত চিত্তরঞ্জন দাস সম্পাদিত পত্রিকা নারায়ণ-এর লেখকসুচিতে রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে চিত্তরঞ্জন দাসের রবীন্দ্র বিরোধিতা প্রসঙ্গের অবতারণায়।

Latest Videos

আরও পড়ুন- শুধুমাত্র স্টিল ছবির অভিজ্ঞতা দিয়েই সিনেমার নতুন ভাষা বানিয়েছিলেন সুব্রত মিত্র

চিত্তরঞ্জনকে রবীন্দ্র বিরোধী ভাবার যথেষ্ট কারণ অবশ্য ছিল। তখনকার প্রায় সব বিশিষ্ট লেখক নারায়ণ পত্রিকায় লিখতেন। নারায়ণ পত্রিকা লেখককে পারিশ্রমিকও দিত। লেখকদের তালিকায় ছিলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিপিনচন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট পরিচিত নাম হওয়া স্বত্বেও রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখাই নারায়ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। বরং নারায়ণ একসময়  রবীন্দ্র-বিরোধিতার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল।নারায়ণের রবীন্দ্রবিরোধিতার পেছনে যে চিত্তরঞ্জন দাশের সায় ছিল তা বলাই বাহুল্য। পত্রিকার প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই রবীন্দ্র-সমালোচনামূলক এক বা একাধিক রচনা প্রকাশিত হত।


রবীন্দ্রসাহিত্যের বিষয়ে বিপিনচন্দ্র পাল ওই সময় বাস্তবতার অভাব আছে বলে  অভিযোগ করেছিলেন। বিপিন পালের অভিযোগে পুরোপুরি সায় না দিলেও রবীন্দ্রসাহিত্য মূল্যায়নে চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য ছিল বিপিন পালের মতোই। অথচ মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যকেই চিত্তরঞ্জন খাঁটি বাংলা সাহিত্য বলে মনে করতেন। তার এই বক্তব্যের নমুনা মেলে তাঁর ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা’, ‘কবিতার কথা’, ‘রূপান্তরের কথা’ প্রভৃতি প্রবন্ধে।  

চিত্তরঞ্জন বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য যে কোনও কিছুতে পাশ্চাত্য প্রভাবকে ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। যে কারণে তিনি পাশ্চাত্যের প্রভাব এড়িয়ে চলার কথা বলতেন। তিনি এ কথাও বলতেন, ব্রিটিশ এ দেশে আসার আগে পর্যন্ত বাঙালি জীবনের সবকিছুই ছিল ভালো। ব্রিটিশ শাসনের ফলেই এ দেশের সবকিছুতে পচন ধরে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, বিকৃতি দেখা দেয় এবং তা শেকড়বিচ্ছিন্ন ও বাস্তবসম্পর্কশূন্য হয়ে পড়ে।

কেবল জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই নয়,  ধর্মচিন্তা, শিল্পনীতি-সহ আরও নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মতের অমিল ছিল খুব স্পষ্ট। শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদান প্রদানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে চিত্তরঞ্জন ‘আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার কথা’য় লিখলেন: ‘বাঙ্গলার মাটিতে, বাঙ্গলার ভাষায় যে শিক্ষা সহজে দেওয়া যায় এবং যে শিক্ষা বাঙ্গালী তাহার স্বভাবগুণে সহজেই আয়ত্ত করে সেই শিক্ষাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট’।চিত্তরঞ্জন পারিবারিক সূত্রে ব্রাক্ষ্ম হওয়া স্বত্বেও নিজের মেয়ের বিয়েতে হিন্দুরীতি পালন করায় ব্রাহ্মসমাজের নেতারা সে-বিবাহ অনুষ্ঠান বর্জন ও চিত্তরঞ্জনকে একঘরে করার চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।  

চিত্তরঞ্জনও তাঁর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রবিদ্বেষের অভিযোগ অস্বীকার করেন বলেছিলেনঃ ‘কথাটা ঠিক হল না, আমি রবিবিদ্বেষী একেবারেই নই, অলৌকিক প্রতিভা আমি কখনও অস্বীকার করি না, তবে তাঁর সব লেখাই যে ভাল লাগে তা বলতে পারি না’। তার মানে রবীন্দ্র-প্রতিভা নিয়ে চিত্তরঞ্জন দাসের কোনো প্রশ্ন ছিল না। দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল, তাই চিত্তরঞ্জন হয়ত নিজের অজান্তে রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাতেও  নারায়ণ পত্রিকায় রবীন্দ্রবিরোধী লেখা ছাপা হওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সৌহার্দ্য কিংবা সৌজন্যটায় কোনও ঘাটতি ছিল না। অন্তত দেশব্রতী চিত্তরঞ্জনের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধা কত গভীর ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে লেখা ‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান’।

Share this article
click me!

Latest Videos

'ভোট ব্যাঙ্কের জন্যই WAQF Board তৈরি করেছে Congress' বিস্ফোরক PM Modi | PM Modi Speech
প্রকাশ্যে হুমকি! মমতার এই নেতার মুখের ভাষা...বিরোধীদের যা বললেন! দেখুন | Malda News Today |
বিয়ে করার জন্য পাত্রী তুলতে এসে শ্রীঘরে পাত্র, হুলুস্থুলু কাণ্ড কুলতলিতে | Kultali News
২৬ এর নির্বাচনে কী থাকবেন ফিরহাদ হাকিম? বাতলে দিলেন শমীক ভট্টাচার্য #shorts #shortsfeed #bjp #tmc
হাড়োয়ায় তৃণমূল জিততেই বিজেপি প্রার্থীর জমি তচনচ, ক্ষোভ উগরে যা বললেন Samik Bhattacharya