রামধনু রাঙা এক জীবনের স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। আর তাঁর সেই মন তাঁকে উড়িয়ে নিয়ে যেত এই পৃথিবী ছাড়িয়ে ছায়াপথ-কক্ষপথ ছাড়িয়ে আরও দূর কোনও জ্যোতিষ্কলোকে। যত না কথা বলতে ভালোবাসতেন, তার থেকে বেশি মগ্ন হয়ে থাকতেন বইয়ের পাতায়। আর নিজের একাকিত্বে টেলিস্কোপে চোখ রেখে আকাশ-বাতাস থেকে দূর মহাকাশে বিচরণ করতেন তিনি। বলিউডে হঠকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভাব নেই, দশকের পর দশক এমন বহু অভিনেতা ভারতীয় চলচ্চিত্রে এসেছেন যাঁদের সঙ্গে গ্ল্যামার শব্দটার সেভাবে সহবাসই ছিল না। নিজের দুনিয়াতে বাঁচতেন এঁরা। শুধু শ্যুটিং-এর সময়টুকুই এঁদের ফ্লোরে পাওয়া যেত। সুশান্ত সিং রাজপুত এতটা হটকে ছিলেন কি না তা নিয়ে একটু সন্দেহ আছে। তবে, মনে মনে যে তিনি বলিউডের মানসিকতা থেকে অনেকটা দূরেই চলে গিয়েছিলেন তা প্রমাণ করে দিল ১৪ জুন, ২০২০। কারণ, যে সুশান্ত এক স্বপ্নের জীবনের জন্য সবকিছু বাজি রাখতে পারতেন, জীবনের সেই বাজিকর মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই চলে গেলেন। ফেলে গেলেন আফশোস করার মতো এক সম্ভাবনাময় কেরিয়ার। বান্দ্রার বাড়িতে সুশান্তের ঝুলন্ত দেহটা উদ্ধার হতেই যেন শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন সকলে।
কাই-পো-চে দিয়ে বলিউডে যাত্রা শুরু। তার আগে ২০০৮ সালেই ছোটপর্দা দিয়ে যাত্রা শুরু। পবিত্র রিস্তা তাঁকে নিয়ে এল ছোটপর্দার পাদপ্রদীপে। বিপরীতে অঙ্কিতা লোখান্ডে। যার সঙ্গে সিরিয়াল চলতে চলতেই বাগদান সেরেছিলেন সুশান্ত। কিন্তু, তাঁর প্রথম ছবি কাই পো-চে মুক্তি পাওয়ার পরই সেই সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ২০১৬ সালে বাগদান ভেঙে দেন সুশান্ত।
কাই পো-চে-র পর থেকে পেশাদার জীবনে শুধুই সাফল্যের সিঁড়ি চড়ে গিয়েছিলেন। বলিউডে কুর্ণিশ জানিয়েছিল তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে। যেভাবে নিষ্ঠা নিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতেন তাতে তাঁকে সকলেই বলিউডের নতুন শাহেনশা বলতেও শুরু করেছিল। একের পর এক ছবি শুদ্ধ দেশি রোমান্স থেকে শুরু করে পিকে, ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সি, এম এস ধোনি দ্য আনটোল্ড স্টোরি। কিন্তু, এরপর যেন একটু হোঁচট খেতে থাকছিল সুশান্তের ছবি-র বক্স অফিস রেটিং। কারণ রাবতা, শোনচিরিয়ে, ছিছোঁড়ে সবই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। এমনকী, এতে সুশান্তের অভিনয়ও সেভাবে কোনও আলাদা করে দাগ কাটেনি। মাঝে কেদারনাথে নায়িকা হিসাবে অভিষেক করা সারা আলি খান-এর বিপরীতে অভিনয়। ছবিটি প্রশংসিত হলেও বক্স অফিসে বিগ হিটের মশালা এতে ছিল না। সম্প্রতি জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজের বিপরীতে নেটফ্লিক্সে ড্রাইভ বলে একটি ওয়েব রিলিজ করেন। কিন্তু, কমেডি অ্যাকসন ড্রামাওয়ালা সেই ছবি-র রেটিং-ও প্রশংসারযোগ্য ছিল না। সুশান্তের হাতে কিছু ছবি থাকলেও, সেগুলিও বিশাল কিছু বড় প্রজেক্ট ছিল না।
বলতে গেলে গত এক বছরে আয়ুষ্মান খুরানা, রাজকুমার রাও-রা শুধুই সাফল্যের সিড়ি ধরে আরও উপরে চড়েছেন, অথচ এদের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে থাকা সুশান্ত ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছিলেন। আর যতই তিনি এটা অনুভব করছিলেন ততই যেন নিজেকে নিজের জগতে বেঁধে নিচ্ছিলেন। বাড়িতে আলাদা একটা কল্পলোক তৈরি করেছিলেন সুশান্ত। আর সেই কল্পলোকটা ছিল একদম তাঁর দেখা স্বপ্নের মতো। যেখান থেকে তিনি মহাকাশে পাড়ি দিতেন শক্তিশালী টেলিস্কোপের হাত ধরে, আবার ডুবে যেতেন বইয়ের সমুদ্রে। আর এভাবেই আস্তে আস্তে বলিউডের স্টারডম ক্যারেকটার থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন সুশান্ত সিং রাজপুত।
জীবনকে বারবার ভেঙেছেন গড়েছেন। স্কুল জীবন থেকে কলেজজীবনে মজে থাকতেন নাসার নভোশ্চরদের কীর্তিকলাপে। মেধাবী, দুরন্ত রেজাল্ট করা সুশান্ত সত্যি সত্যি নাসার অ্যাপোলো স্পেসক্রাফটে পাড়ি দিতে চাইতেন মহাকাশে। সেই স্বপ্নে যখন ছেদ পড়ল তখন তিনি নেমে পড়লেন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। সেখানেও মন টিকল না। কারণ ২০০২ সালে মা-এর প্রয়াণ ১৬ বছরের কিশোরের মনে যে ক্ষত তৈরি করেছিল তা হয়তো কোথাও একটা ফাঁক তৈরি করেছিল। তাই আচমকাই ডান্সিং ও অ্যাক্টিং-এর মধ্যে ঝুঁকে পড়েছিলেন। সেখান থেকে বলিউড। কিন্তু, শিঁকড়টা যে নাসার স্বপ্নে পড়ে রয়েছে তা বুঝতেন সুশান্ত। তিনি এমন এক পরিণতির দিকে নিজেকে নিয়ে গেলেন তাকে হয়তো অনেকেই দুর্ভাগ্যজনক বলবে, কিন্তু সুশান্ত কী পৌঁছতে পারলেন বৃহস্পতি পেরিয়ে প্লুটো-নেপচুনদের দিকে। সুশান্ত ৩৪-এ যে অভিনয়ের ছটা দিয়ে বিদায় নিয়েছে তা থেকে যাবে সকলের হৃদয়ে।